ব্যর্থ হল চার দিনের প্রাণান্তকর চেষ্টা আর সারা বিশ্বের প্রার্থনা। মরক্কোর এক কুয়ায় পড়ে যাওয়া পাচ বছরের ছোট্ট শিশুটি শেষ পর্যন্ত মারা গেল।
রায়ান ওমর নামের শিশুটি কয়েকদিন আগে অসাবধানতাবশত পড়ে যায় গভীর ঐ কুয়াটিতে। তার বাবা সেসময় কুয়াটি সংস্কার করছিলেন। সরু লম্বা কুয়াটির প্রায় ৩২ মিটার গভীরে চলে যায় রায়ান। শিশুটির বাবা দ্রুত সাহায্যের জন্য ছুটে গেলেও তার আগেই রায়ানের দেহ কুয়ার অনেকটা গভীরে নেমে যায়।
খবর পেয়ে উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌছালেও শিশুটিকে উদ্ধারে বেগ পেতে হয় তাদের। কারণ কুয়াটি সরু হওয়ায় সেখানে উদ্ধারকারীদের প্রবেশ করা সম্ভব হচ্ছিলনা।
উদ্ধারকারী দল কুয়ায় আটকে পড়া রায়ানের অবস্থা জানতে এর ভেতরে একটি ক্যামেরা প্রবেশ করায়। তাতে তোলা ভিডিওতে শিশুটিকে জীবিত অবস্থায় দেখা যায়। তবে তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন ছিল।
দ্রুত শিশুটির জন্য অক্সিজেন, খাবার ও পানি পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। তবে রায়ান আদৌ শেষ পর্যন্ত সেগুলো নিয়ে ব্যবহার করতে পেরেছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সরাসরি কুয়াটিতে প্রবেশের সুযোগ না থাকায় এর কিছুটা পাশে একটি প্রশস্ত গর্ত খুড়ে রায়ানের সর্বশেষ অবস্থান পর্যন্ত গভীরতায় পৌছে এরপর পাশ বরাবর শিশুটির কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করে উদ্ধারকারীরা।
তবে এতে ঝুকি ছিল মাটিধসের। সেকারণে উদ্ধারকারীরা বুলডোজারের সাহায্যে আরও চওড়া করে পরিখা খনন শুরু করে। সারাদিন ধরে পালা করে এই কাজে অংশ নেয় উদ্ধারকারীরা। রাতেও ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে খননকাজ অব্যাহত রাখে তারা।
শেষ পর্যন্ত চতুর্থ দিনে এসে শিশুটির অবস্থান বরাবর পৌছাতে সক্ষম হয় উদ্ধারকারী দল। এরপর পাশ বরাবর মাটি খুড়ে রায়ানের কাছে পৌছায় তারা। এসময় বড় পাইপ ব্যবহার করা হয় যাতে গর্ত বরাবর মাটি ধসে পড়তে না পারে।
এছাড়া উদ্ধার তৎপরতা চলার সময় কয়েক ঘন্টা পরপর কাজ থামিয়ে মাটির সর্বশেষ অবস্থা পরীক্ষা করতে হয় তাদেরকে যেন কোন দূর্ঘটনা না ঘটে।
এদিকে রায়ানের কুয়ায় আটকে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি হয় মরক্কো জুড়ে। ছোট্ট শিশুটির প্রাণরক্ষার প্রার্থনায় নজিরবিহীন এক ঐক্যের আবহ তৈরি হয় দেশটিতে। দল, মত, জাতি, গোত্র নির্বিশেষে দেশটির সর্বস্তরের মানুষ গত চার দিন ধরে কামনা করে গেছে রায়ানের বিপদমুক্তির।
কুয়াটি ঘিরে যখন ভারী যন্ত্রপাতি, বিশেষজ্ঞ আর উদ্ধারকারীরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন রায়ানকে উদ্ধারের জন্য, তখনও পুরো এলাকাজুড়ে শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছে কোন সুসংবাদ শোনার আশায়।
তারা একসাথে ধর্মীয় গান গেয়েছে, প্রার্থনা করেছে। কেউ কেউ রাতের পর রাত অবস্থান করেছেন ঘটনাস্থলে।
শুধু মরক্কোই নয়, রায়ান ওমরের দূর্ঘটনার খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার হতেই সারাবিশ্ব থেকে সহমর্মিতার বার্তা আসতে শুরু করে। শিশুটির দ্রুত উদ্ধার কামনায় শরিক হয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লক্ষ লক্ষ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘সেভ রায়ান’ হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে বহু মানুষ তাদের সহমর্মিতা জানায়।
তবে শেষ পর্যন্ত তাদের সব প্রত্যাশা পরিণত হয় হতাশায়। কুয়া থেকে উদ্ধার করা হয় রায়ানের নিথর দেহ। উদ্ধারকারীরা তার কাছে পৌছানোর আগেই মারা গিয়েছিল সে। তবে কুয়া ঘেকে রায়ানের দেহ বের করার সময় তার মৃত্যুর কথা জানানো হয়নি কিংবা উদ্ধারকারীরা নিজেরাও নিশ্চিত ছিলেননা।
ফলে রায়ানকে বের করার খবরে উল্লাস প্রকাশ করতে থাকে উপস্থিত লোকজন। গণমাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার দেখে বহির্বিশ্ব থেকেও শিশুটির ‘নিরাপদ উদ্ধারের’ ঘটনায় স্বস্তি প্রকাশ করা হতে থাকে।
কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে এম্ব্যুলেন্সে করে রায়ানের দেহ নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হয় তার মৃত্যুর কথা। শোক আর হতাশায় ডুবে যায় সকলে।
মরক্কোর বাদশাহ পঞ্চম মোহাম্মেদ রায়ানের বাবা-মাকে ফোন করে গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। শোক প্রকাশ করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানূয়েল ম্যাক্রো।
২০১৯ সালে স্পেনের মালাগা শহরে অনেকটা একই রকম দূর্ঘটনায় একটি বোরহোলের মধ্যে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিল দু’বছর বয়সী আরেকটি শিশু।