জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর দায়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা প্রস্তাব পাশ করেছে। সাধারণ পরিষদ একই সাথে অবিলম্বে হামলা বন্ধ করে ইউক্রেনের মাটি থেকে রাশিয়ার সব সেনা ও সমরাস্ত্র ফিরিয়ে নেওয়ারও দাবি জানিয়েছে।
আজ সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা নিন্দা প্রস্তাবে ১৪১টি দেশ পক্ষে ভোট দেয়। সাধারণ পরিষদের জরুরি এই অধিবেশনটি আহবান করেছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ। এর আগে সর্বশেষ ১৯৮২ সালে নিরাপত্তা পরিষদের ডাকে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসেছিল জাতিসংঘে।
অধিবেশনে পাশ হওয়া প্রস্তাবে ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসন’ এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এমন এক সময় এই প্রস্তাবটি পাশ হল যখন ইউক্রেনের সেনারা রাশিয়ার বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে দেশটির বন্দরনগরী খেরাসনকে রক্ষার জন্য তীব্র লড়াই চালাচ্ছে। রুশ আক্রমণে শহরটি থেকে এরই মধ্যে দলে দলে লোক নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করেছে।
সাধারণ পরিষদে আনা নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে প্রায় দেড় শতাধিক রাষ্ট্রের সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়াসহ পাঁচটি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। বাকি দেশগুলো হল বেলারুশ, ইরিত্রিয়া, উত্তর কোরিয়া ও সিরিয়া। রাশিয়ার প্রতিবেশী বেলারুশের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো মস্কোর প্রতি তার আনুগত্যের জন্য পরিচিত। পশ্চিমা বিরোধী হিসেবে পরিচিত উত্তর কোরিয়ারও রাশিয়ার সাথে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। আর দশকব্যাপী চলা গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদকে সর্বোতভাবে সাহায্য করায় সিরিয়াও যেকোনো ইস্যুতে পাশে থাকে রাশিয়ার।
অন্যদিকে পক্ষ-বিপক্ষের বাইরে মোট ৩৫টি দেশ আজকের প্রস্তাবে ভোটদান থেকে বিরত ছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে রয়েছে চীন। দেশটির সাথে পশ্চিমাদের তিক্ত সম্পর্ক এবং রাশিয়ার সাথে মিত্রতার কারণে ধারণা করা হচ্ছিল চলমান ইউক্রেন সংকটে মস্কোকে সার্বিক সমর্থন জানাবে বেইজিং। কিন্তু তার পরিবর্তে বরং নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে চীনকে। আজকের ভোটদানে বিরত থাকা ছাড়াও ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর থেকেই সরাসরি কারও পক্ষাবলম্বন না করে উভয় পক্ষকে সংযত রাখার কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে চীন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাশ হওয়া প্রস্তাবগুলো অনেকটাই প্রতীকী, কারণ এগুলো কার্যকর করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তবে কোন দেশের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য রাষ্ট্র সমর্থন জানালে দেশটির বিরুদ্ধে একপ্রকার নৈতিক চাপ সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে সাধারণ পরিষদে না হলেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কোন প্রস্তাব ‘ভেটো ছাড়া’ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে গৃহীত হলে সেটি কার্যকর করাটা বাধ্যতামূলক। ৫টি স্থায়ী ও ১০টি অস্থায়ী মিলিয়ে পরিষদের মোট ১৫ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতার পাশাপাশি ঐ ৫ স্থায়ী সদস্যের (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স) কারোরই প্রস্তাবটির বিপক্ষে আপত্তি না থাকলেই কেবল সেটি পাশ হবে এবং তা কার্যকর করতে কোন বাধা থাকবেনা।
ইউক্রেন ইস্যুতে নিরাপত্তা পরিষদেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অনুরূপ প্রস্তাব সম্প্রতি তোলা হয়েছিল। ধারণামতই, পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া তাদের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবটি ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে আটকে দেয়।
সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা নিন্দা প্রস্তাব পাশ হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্থনি ব্লিংকেন। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, রাশিয়ার আগ্রাসন শুধু ইউক্রেনের জন্য নয়, পুরো ইউরোপের নিরাপত্তার জন্যই হুমকি।
জাতিসংঘে মার্কিন দূত আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গের জন্য মস্কোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন। তিনি ইউক্রেন যুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ ক্লাস্টার বোমা ও ভ্যাকিউম বোমা পরিবহন ও ব্যবহারের অভিযোগ তোলেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে।
বিপরীতে জাতিসংঘে রুশ প্রতিনিধি তাদের বিরুদ্ধে তোলা ‘আইন লঙ্ঘনের’ অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছেন, সাধারণ পরিষদের আজকের ভোটাভুটিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অনেক দেশকেই চাপ দিয়েছে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো।
হামলা শুরুর এক সপ্তাহ পরেও প্রত্যাশিত লক্ষ্যের কাছেও এখনও পর্যন্ত পৌছাতে পারেনি রাশিয়া। অল্প ক’দিনেই রাজধানী কিয়েভের পতন ঘটবে বলে যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল, ইউক্রেনীয় সেনা ও সাধারণ মানুষের প্রবল প্রতিরোধের কারণে বাস্তবে তেমনটা হয়নি। দেশটির অন্যান্য শহর দখলেও অপ্রতাশ্যিত প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে রুশ বাহিনী।
ইউক্রেনে হামলার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার রাশিয়া এবং পুতিনসহ দেশটির সামরিক ও বেসামরিক শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো। এই ধারা আরও অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এতে করে রাশিয়ার অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়লেও ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে পুতিন সরে আসবেন কিনা তা সময়ই বলবে।