ইউক্রেনে আগ্রাসন এবং সেখানে চালানো মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগের ভিত্তিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ থেকে বহিষ্কার করা হল রাশিয়াকে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর পর গত দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমাগত হামলা চালিয়ে আসছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। যতটা সহজে ইউক্রেন দখল করে নিতে পারবে বলে মনে করা হয়েছিল, বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি রাশিয়ার পক্ষে। রাজধানী কিয়েভ তো বটেই, রুশ সীমান্তবর্তী পূর্বাঞ্চলীয় কিছু এলাকা ছাড়া ইউক্রেনের কোন অংশেই নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি মস্কো।
যুদ্ধ শুরুর পর ইউক্রেনের হাতেগোনা কয়েকটি শহর দখল করে নিতে পারলেও সেগুলোর মধ্যে কয়েকটি থেকেও একসময় পিছু হটতে হয় রাশিয়াকে। তেমনি একটি শহর বুচাকে কেন্দ্র করেই জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সদস্যপদ হারালো রাশিয়া।
গত সপ্তাহে কিয়েভের নিকটবর্তী শহর বুচা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে রাশিয়া। শহরটিতে ইউক্রেনীয় বাহিনী পুনরায় নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার পর থেকে উঠে আসতে থাকে সেখানে বিগত দিনগুলোতে রাশিয়ার চালানো নৃশংসতার চিত্র।
বুচার বেশকিছু সড়কে এলোপাথাড়ি পড়ে থাকতে দেখা যায় কয়েক ডজন বেসামরিক নাগরিকের মৃতদেহ। নিরস্ত্র এসব মানুষের কারও কারও হাত পেছন থেকে, কারওবা পা বাধা ছিল। মৃতদেহগুলো দেখে অনুমান করা যায়, তাদেরকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। তাদের কাছে কিংবা আশেপাশে কোন অস্ত্রের দেখা মেলেনি, ফলে তারা কারও জন্য হুমকি ছিলেননা, নেহাতই স্থানীয় সাধারণ বাসিন্দা ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর শহরটি রুশ বাহিনীর দখলে ছিল বিধায় এসব হত্যাকান্ডও তাদের দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে বলে দাবি ইউক্রেন সরকারের।
বুচার রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলোর ভিডিওচিত্র প্রকাশ্যে আসতেই সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় বিশ্বজুড়ে। পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি এমনকি যেসব রাষ্ট্র এতদিন রুশ আগ্রাসনের সমালোচনা থেকে বিরত ছিল তাদেরও অনেকে স্পষ্টভাবে এই হত্যাকান্ডের নিন্দা জানিয়েছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকি এটিকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছেন। রাশিয়া বুচায় হত্যাকান্ড চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছে। মস্কোর দাবি, ইউক্রেনে তারা ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ পরিচালনা করছেন, ফলে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করার দাবি ভিত্তিহীন।
বুচায় সংঘটিত হত্যাকান্ডের খবর সামনে আসতেই নড়েচড়ে বসে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মানবাধিকার শাখায় গত সপ্তাহে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করেন জাতিসংঘে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড। এতে মানবাধিকারের গুরুতর লংঘনের দায়ে রাশিয়াকে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে বহিষ্কারের কথা বলা হয়।
ঐ প্রস্তাবের ওপর গত কয়েকদিন ধরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আলোচনার পর আজ ভোটাভুটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রস্তাবটির পক্ষে ৯৩টি ও বিপক্ষে ২৪টি দেশ ভোট দেয়। ৫৮টি রাষ্ট্র ভোটদান থেকে বিরত ছিল।
সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ প্রস্তাবটির সমর্থনে ভোট দেওয়ায় এটি গৃহীত হয় এবং প্রস্তাবনামত রাশিয়াকে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, কানাডাসহ পশ্চিমা ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয়। বিপরীতে চীন, ইরান, সিরিয়া, বেলারুশের মত দেশগুলো ভোট দেয় বিপক্ষে।
মানবাধিকার পরিষদ থেকে রাশিয়াকে বহিষ্কারের প্রস্তাব নিয়ে চলা আলোচনায় অন্যান্যদের মধ্যে অংশ নেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি গণহত্যার অভিযোগগুলো তদন্ত ও এর বিচারের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের আদলে আন্তর্জাতিক আদালত গঠনের দাবি জানান।
রাশিয়ার আগে সর্বশেষ ২০১১ সালে লিবিয়াকে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। বিরোধী দলগুলোর ওপর তৎকালীন মুয়াম্মার গাদ্দাফির নেতৃত্বাধীন সরকারের সহিংস দমনপীড়নের দায়ে দেশটিকে এই শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। প্রতিষ্ঠার পর মানবাধিকার পরিষদ থেকে কোন সদস্য রাষ্ট্রকে বহিষ্কারের সেটিই ছিল প্রথম এবং একমাত্র ঘটনা। এবার রাশিয়া পরিণত হল সংস্থাটি থেকে বহিষ্কৃত দ্বিতীয় দেশে।