দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয়ের বার্ষিকীতে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বড় কোন ঘোষণা দেবেন বলে শোনা যাচ্ছিল গত কয়েকদিন থেকে। কিন্তু মস্কোর রেড স্কয়ারে আয়োজিত বার্ষিক কুচকাওয়াজে দেওয়া ভাষণে আদতে তেমন কিছুই বললেন না রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
পুতিন তার বক্তব্যে ইউক্রেন যুদ্ধকে ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের সাথে তুলনা করেন। চলমান সংঘাতের জন্য তিনি পশ্চিমা দেশগুলো ও ন্যাটো জোটকে দায়ী করেন। পুতিনের অভিযোগ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে তার দাবিগুলো পশ্চিমারা প্রত্যাখ্যান করায় এই সংকট উদ্ভূত হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর ১০ সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত সেখানে গর্ব করার মত কোন সাফল্য দেখাতে পারেনি ক্রেমলিন। রুশ সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল ছাড়া দেশটির কোথাওই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি তারা। উল্টো শুরুতে দখল করা এলাকাগুলো থেকেও ইউক্রেনের প্রতিরোধের মুখে একসময় সরে আসতে হয়েছে রুশ বাহিনীকে।
এরই মধ্যে কয়েক হাজার রুশ সেনার মৃত্যু হয়েছে যুদ্ধের ময়দানে, আহত হয়েছেন আরও কয়েক গুণ। ইউক্রেনের সেনা ও বেসামরিক নাগরিকরাও বেশ বড় সংখ্যায় প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া মারিওপোলসহ দেশটির কয়েকটি শহরকে মিসাইল আর ট্যাংকের গোলায় কার্যত গুড়িয়ে দিয়েছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী।
সর্বশেষ রবিবার ইউক্রেনের একটি স্কুলে রাশিয়ার বোমাবর্ষণের ঘটনায় অন্তত ৬০ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া লুহানস্ক শহরে নতুন করে বোমাবর্ষণ শুরু করেছে রুশ সেনারা।
এতকিছু করেও ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে কাঙখিত সাফল্য না পাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছিল আজকের কুচকাওয়াজ থেকে এমন কোন ঘোষণা প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন করবেন, যা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে তার দিকে।
যুদ্ধের সব উপাদান বিদ্যমান থাকলেও শুরু থেকেই ইউক্রেনে তাদের হামলাকে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ হিসেবে অভীহিত করে আসছিল রাশিয়া। জল্পনা চলছিল, আজকের ভাষণে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আর অভিযান নয়, পরিবর্তে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের ডাক দিতে পারেন পুতিন।
এর পেছনে কারণ হল, ইউক্রেন সংঘাতের বর্তমান যা গতিপ্রকৃতি, তাতে পশ্চিমা অস্ত্রসাহায্যে ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকা ইউক্রেনীয় প্রতিরোধকে প্রতিহত করতে হলে কার্যত সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে রুশ বাহিনীকে। কিন্তু প্রচলিত সামরিক কাঠামো অনুযায়ী, ‘অভিযানের’ ক্ষেত্রে সক্ষমতার সর্বোচ্চটুকু প্রয়োগ করতে পারেনা সশস্ত্র বাহিনী, যা ‘যুদ্ধের’ বেলায় সম্ভব। তাই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে চলমান ‘বিশেষ সামরিক অভিযানকে’ আনুষ্ঠানিক ‘যুদ্ধে’ উন্নীত করার কথা শোনা যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই, যা আজকের বিজয় দিবসের বিশেষ দিনেই রুশ প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করবেন বলে শোনা যাচ্ছিল।
কিন্তু তার ১১ মিনিটের বক্তব্যে আজ সেরকম কোন ঘোষণাই করেননি ভ্লাদিমির পুতিন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় রাশিয়ার এবছরের বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজটির জৌলুস ছিল কিছুটা কম। দেশটির সংবাদ মাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, ১১,০০০ সেনা ও ছোটবড় মিলিয়ে ১৩১ টি সামরিক যান অংশ নেয় কুচকাওয়াজে।
আজকের কুচকাওয়াজে ভ্লাদিমির পুতিনসহ রাশিয়ার শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক কর্তারা উপস্থিত থাকলেও তাৎপর্যপূর্ণভাবে দেখা যায়নি রুশ সামরিক বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ ভ্যালেরি গেরাসিমভকে। শোনা যাচ্ছে, সম্প্রতি দোনবাস প্রদেশের যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শনের সময় আহত হয়েছেন তিনি।
এদিনের কুচকাওয়াজে আরও একটি উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি ছিল রুশ বিমান বাহিনীর বিশেষ এক ফ্লাইপাস্ট। গত কয়েকদিন ধরে মস্কোর আকাশে একঝাক রুশ বিমান ইংরেজি ‘জেড’ অক্ষরের আদলে অবস্থান নিয়ে ঊড়তে থাকার মহড়া দেয় আজকের কুচকাওয়াজে পরিবেশনের জন্য। কিন্তু ‘আবহাওয়া অনুকূলে’ না থাকার কারণে শেষ মূহুর্তে বাতিল করা হয় সেই পরিবেশনা। উল্লেখ্য, ইউক্রেন যুদ্ধে ‘জেড’ অক্ষরটি ব্যাপকাভাবে ব্যবহার করছে রাশিয়া, যা দিয়ে মূলত বিজয় বোঝানো হয় সেখানে।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় দিবস উপলক্ষে পৃথক এক বাণীতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকি বলেছেন, ১৯৪৫ সালে যে ইউক্রেনের মাটি থেকে নাৎসিদের বিতাড়ন করা হয়েছিল, সেই ইউক্রেনের বিজয় কাউকে ছিনিয়ে নিতে দেয়া হবেনা। রাশিয়ার সাথে চলমান সংঘাতের প্রসঙ্গ টেনে জেলেন্সকি বলেন, খুব শীঘ্রই ইউক্রেন আরও একটি বিজয় দিবস পাবে উদযাপনের জন্য।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বর্তমান রাশিয়া ও ইউক্রেন একই সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। ঐ যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট ২ কোটি ৭০ লক্ষ লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ৮০ লক্ষই ছিলেন আজকের ইউক্রেনের নাগরিক।