ইউরোপের দুই প্রতিবেশী দেশ সুইডেন ও ফিনল্যান্ড আজ নিশ্চিত করেছে, তারা ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছে। দশকের পর দশক নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার পর সম্প্রতি ন্যাটোতে যোগদানের জন্য দেশ দু’টো সক্রিয় হয়ে ওঠে।
গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকেই নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ইউরোপের প্রতিবেশী এই দুই রাষ্ট্র। রাশিয়া তাদের দেশেও কোনো একদিন হামলা চালিয়ে বসতে পারে, এই আশংকায় তড়িঘড়ি ন্যাটোতে যোগদানের উদ্যোগ নেয় তারা।
ন্যাটোর সনদ অনুযায়ী, এর কোনো সদস্য রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে তা জোটটির বাকি সদস্যদের ওপরেও আক্রমণ বলে বিবেচিত হবে। সেইমত ন্যাটোর সবক’টি সদস্য দেশই ঐক্যবদ্ধভাবে হামলাকারী দেশকে সামরিক প্রত্যাঘাত করবে।
মূলত এই বিধানটির কারণেই ইচ্ছা থাকা স্বত্তেও ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি অংশ নিতে পারছেনা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো। কারণ ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। তাই দেশটিতে কেবল অস্ত্র পাঠানোতেই নিজেদের সামরিক সহায়তা সীমিত রাখতে হচ্ছে তাদের।
সুইডেনে আজ ক্ষমতাসীন দল ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেটস’ ন্যাটোতে যোগদানের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এর ফলে দেশটির সরকার এখন ন্যাটোর কাছে সদস্যপদ পাওয়ার আনুষ্ঠানিক আবেদন জানাতে পারবে। সুইডেনের বিরোধী দলগুলোও এই প্রস্তাবের পক্ষে তাদের সমর্থন জানিয়েছে। দেশটির জনমত জরিপগুলোতেও বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের পক্ষে মত দিচ্ছেন।
এর কয়েক ঘন্টা আগে দেশটির প্রতিবেশী ফিনল্যান্ডও ন্যাটোতে যোগদানের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল। ফিনল্যান্ডের জন্য রুশ হামলার ঝুকি সুইডেনের চেয়েও বেশি। কারণ রাশিয়ার সাথে দেশটির দীর্ঘ ১,৩০০ কিলোমিটারের স্থলসীমান্ত রয়েছে।
সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী ম্যাগডালিনা আন্ডারসন আজ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ন্যাটোতে যোগদান হবে সুইডেন এবং সুইডিশ জনগণের নিরাপত্তার জন্য নেওয়া সেরা সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, কোনো জোটে যোগ না দেওয়ার এতদিনকার নিরপেক্ষ অবস্থান সুইডেনের জন্য সঠিকই ছিল, কিন্তু আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে তা ভবিষ্যৎের জন্য আর সঠিক হবেনা।
প্রতিবেশী ফিনল্যান্ডের সিদ্ধান্তের দিকে ইঙ্গিত করে ম্যাগডালিনা বলেন, সুইডেন যদি ন্যাটোর বাইরে থাকা বাল্টিক অঞ্চলের একমাত্র দেশে পরিণত হয়, তবে তা সুইডেনকে ঝুকিপূর্ণ এক অবস্থানে ফেলে দেবে।
এর আগের দিন ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সওলি নিনিস্তো অনুরূপ সংবাদ সম্মেলনে তার দেশের ন্যাটোতে যোগদানের প্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি জানান, তিনি টেলিফোনে স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকেও এব্যাপারে অবহিত করেছেন। কারণ ফিনল্যান্ড যা করবে প্রকাশ্যে করবে, গোপনে নয়।
ভ্লাদিমির পুতিন তার প্রতিক্রিয়ার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ন্যাটোতে যোগ দিলে ফিনল্যান্ড ‘ভুল’ করবে। উল্লেখ্য, ইউক্রেনে তার অভিযানের জন্য বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য কারণের সাথে দেশটির ন্যাটোতে যোগদানের তৎপরতাকেও দায়ী করে এসেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
এদিকে আলোচনার জন্য বার্লিনে অবস্থানরত ন্যাটো দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যতদিন সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের যোগদানের আবেদন গৃহীত না হয়, ততদিন পর্যন্ত দেশ দু’টির জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহবান জানিয়েছেন।
কারণ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অনুমোদন পাওয়াসহ সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে একবছর সময়ও লেগে যেতে পারে। সেসময়ের মধ্যে রাশিয়ার পক্ষ থেকে যেকোনো অজুহাতে দেশ দু’টিতে বা কোনো একটিতে হামলা চালানোর ঝুকি থেকেই যায়।
এদিকে জোটের আর সব সদস্যের সম্মতি থাকলেও ন্যাটোতে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের যোগদান নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে তুরস্ক। ন্যাটোর এই সদস্য রাষ্ট্রের আপত্তির কারণ অবশ্য দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। তুরস্কের সংখ্যালঘু কুর্দি সম্প্রদায়ের প্রধান সংগঠন হল ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’ (পিকেকে)। তুরস্ক এই দলটিকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে গণ্য করে।
সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শরণার্থী কুর্দি জনগোষ্ঠীর বাস। এমনকি সুইডেনের কয়েকজন সংসদ সদস্যও কুর্দি বংশোদ্ভূত। তুরস্কের অভিযোগ, দেশ দু’টি বহুদিন ধরেই পিকেকে-র পলাতক সদস্যদের আশ্রয় দিয়ে আসছে। মূলত এই অভিযোগের জের টেনেই দেশ দু’টির ন্যাটোতে প্রবেশে আপত্তি জানাচ্ছে তুর্কি সরকার। ন্যাটোর শীর্ষ নেতারা এর প্রেক্ষিতে বলেছেন, তারা এব্যাপারে তুরস্কের সাথে কথা বলবেন।