অবশেষে মারিওপোল শহর পুরোপুরি দখল করে নিল রাশিয়া। কয়েক মাসের প্রাণান্তকর চেষ্টার পর সম্প্রতি শহরটির প্রায় সম্পূর্ণ অংশে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় রুশ বাহিনী। শুধু বন্দরনগরীটির আজভস্টল ইস্পাত কারখানায় মাটি কামড়ে পড়েছিল যোদ্ধাসহ ইউক্রেনের কয়েকশো নাগরিক।
বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই কারখানাটির দখল নিতে ক্রমাগত হামলা চালিয়ে গেছে রাশিয়া। কিন্তু সেখানে অবস্থানরত ইউক্রেনীয়দের কৌশল এবং প্রতিরোধের কারণে বেশ লম্বা সময় পর্যন্ত কারখানাটির নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয় রাশিয়া।
তবে চারিদিক থেকে ঘেরাও হয়ে থাকা ইউক্রেনের কয়েকশো নাগরিকের ঐ দলটির অস্ত্র ও খাবারের মজুদ কমতে থাকার কারণে সীমিত হতে থাকে তাদের প্রতিরোধ। এই অবস্থায় বিভিন্ন পক্ষের মধ্যস্থতায় কারখানা ছেড়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হয় ইউক্রেনের যোদ্ধারা।
এই প্রেক্ষিতে গত কয়েক দিন ধরে ইউক্রেনের সেনা, যোদ্ধা ও বেসামরিক লোকজন মিলিয়ে দেশটির কয়েক হাজার নাগরিককে কারখানাটি থেকে বের করে আনা হয়। আজ যোদ্ধাদের দলের সর্বশেষ সদস্যদের স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে কার্যত আজভস্টল ইস্পাত কারখানার নিয়ন্ত্রণ আনুষ্ঠানিকভাবে হারালো ইউক্রেন।
আর মারিওপোল শহরে ইউক্রেনের শেষ এ ‘ঘাটিটির’ পতনের মধ্য দিয়ে পুরো মারিওপোল শহরের দখল নিজেদের হাতে পেল রাশিয়া। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর থেকে খারকিভ, খেরসন, মারিওপোল থেকে শুরু করে রাজধানী কিয়েভেও ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে মস্কো।
তবে এসব হামলার ক্ষয়ক্ষতিতে দেশটির আর সব অঞ্চলকে ছাড়িয়ে গেছে বন্দরনগরী মারিওপোল। শহরটিকে কার্যত মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে রুশ মিসাইল আক্রমণ। মারিওপোলের ভবনগুলোর একটা বড় অংশই এখন বিধ্বস্ত। হামলা থেকে রেহাই পায়নি থিয়েটার, শপিংমল এমনকি স্কুল এবং হাসপাতালও।
এরকম মূহুর্মুহু হামলার মুখে মারিওপোলে ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ একসময় দূর্বল হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে আজভস্টল ইস্পাত কারখানা ছাড়া শহরের বাকি অংশে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সক্ষম হয় রাশিয়ার সেনারা।
আজ সেই ইস্পাত কারখানাটিরও দখল নেয়ার পর রাশিয়ার প্ততিরক্ষামন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন, ইউক্রেনের শেষ ৫৩১ জন নাগরিক কারখানা প্রাঙ্গণ ত্যাগ করার মধ্য দিয়ে মারিওপোল শহর এবং ঐ কারখানাটি ‘সম্পুর্ণ স্বাধীনতা’ লাভ করল। কারখানার ভূগর্ভস্থ টানেল এবং কক্ষগুলো, যেখানে এতদিন ইউক্রেনের যোদ্ধারা অবস্থান নিয়ে ছিল, সেগুলো আজ পুরোপুরি রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকি আজভস্টলের সর্বশেষ অগ্রগ্রতি সম্পর্কে বলেন, ইস্পাত কারখানার অবশিষ্ট যোদ্ধাদের স্থানটি ত্যাগ করে চলে আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ইউক্রেনের এক টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জেলেন্সকি বলেন, আজ সামরিক কমান্ডের পক্ষ থেকে কারখানায় থাকা যোদ্ধাদেরকে কাছে স্পষ্ট বার্তা পাঠানো হয়েছে যেন তারা কারখানাটি ছেড়ে চলে গিয়ে নিজেদের রক্ষা করে।
আজভস্টল ইস্পাত কারখানার পুরো কমপ্লেক্সটি প্রায় ৪ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত। মূল কারখানার বাইরেও প্রশাসনিক ভবন, শ্রমিক, কর্মী, কর্মকর্তাদের আবাসিক কোয়ার্টার, দোকান মিলিয়ে ছোটখাট একটি শহরের মত এটি।
গত কয়েক সপ্তাহ পুরো এলাকাটি চারিদিক থেকে কার্যত অবরুদ্ধ করে রেখেছিল রাশিয়া। ভেতরে আটকা পড়ে যায় ইউক্রেনের সেনারা ছাড়াও নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ বিপুল সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক। জাতিসংঘ ও রেডক্রসের দীর্ঘ মধ্যস্ততার পর তাদেরকে বাইরে বের করে আনা শুরু হয়।
তবে বেসামরিক লোকেরা চলে এলেও ইউক্রেনের যোদ্ধারা কারখানাটি ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নয় জেনেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় তারা। এই যোদ্ধাদের মধ্যে ইউক্রেনের নৌ ও সেনা বাহিনী, সীমান্তরক্ষী বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও প্রাদেশিক নিরাপত্তা ইউনিটের সদস্যরা রয়েছেন।
প্রতিকূল অবস্থাতেও এভাবে লড়াইয়ে চালিয়ে যাওয়ায় ইউক্রেনে বীরের মর্যাদা পেয়েছেন এই যোদ্ধারা। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে অস্ত্রত্যাগ না করলে রুশ সেনাদের হাতে তাদের মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত বলেই এই যোদ্ধাদের আর লড়াই না চালাতে নির্দেশনা দেন প্রেসিডেন্ট জেলেন্সকি।
সেইমত রুশ বাহিনীর কাছে একে একে আত্মসমর্পণ শুরু করে যোদ্ধারা। তাদেরকে বাসে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাশিয়ার সরকারি সূত্রে সংখ্যাটা ২, ৪৩৯। রুশ হেফাজতে থাকা এই সেনাদের বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়ায় অচিরেই মুক্ত করা সম্ভব হবে বলে আশা করছে ইউক্রেন সরকার।