ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের মৃত্যুর পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের নতুন নেতা হিসেবে মনোনীত হলেন শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। গত সপ্তাহে দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রয়াত হন দেশটির প্রেসিডেন্ট খলিফা বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।
সদ্যপ্রয়াত জায়েদ আল নাহিয়ান ২০০৪ সাল থেকে আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। তবে ২০১৪ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের পর থেকে পর্দার আড়ালে চলে যান জায়েদ। সেসময় থেকেই অনানুষ্ঠানিকভাবে দেশটির রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বভার সামলাচ্ছিলেন তারই সৎভাই মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান।
সাতটি আমিরাত বা প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই সাত আমিরাতের শাসকরাই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দেশের শীর্ষনেতাকে মনোনীত করেন। গত সপ্তাহে খলিফা বিন জায়েদ প্রয়াত হওয়ার পর সাত প্রদেশের শাসকরা কিছুটা দ্রুতই বৈঠকে মিলিত হন। সেখানেই মোহাম্মদ বিন জায়েদকে দেশের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
আরব আমিরাতের সবচেয়ে ধনী প্রদেশ দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাখদুম এক বিবৃতিতে নতুন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, আমরা তার প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করছি, জনগণেরও সমর্থন রয়েছে তার ওপর।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ তার প্রতিক্রিয়ায় সাত প্রদেশের শীর্ষনেতাদের নিয়ে গঠিত ফেডারেল সুপ্রিম কাউন্সিলকে ধন্যবাদ জানান তার ওপর ‘মূল্যবান আস্থা’ রাখার জন্য।
১৯৭১ সালে অর্ধডজন স্বাধীন আমিরাত নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। সেইমত ঐ বছর জন্ম নেয় বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন দেশটির মূল প্রতিষ্ঠাতা শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ান। ২০০৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই পদে ছিলেন তিনি।
জায়েদ বিন সুলতানের মৃত্যুর পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত হন তারই পুত্র খলিফা বিন জায়েদ। ১৮ বছর দায়িত্ব পালনের পর গত সপ্তাহে প্রয়াত হন তিনি।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের নতুন নেতা মোহাম্মদ বিন জায়েদ তার নামের আদ্যক্ষর দিয়ে সংক্ষেপে এমবিজেড হিসেবে পরিচিত। ৬১ বছর বয়সী এই নেতা দৃড়চেতা কিন্তু জনবান্ধব শাসক হিসেবে পরিচিত।
প্রয়াত প্রেসিডেন্টের অসুস্থতাকালে প্রায় এক দশক আরব আমিরাতের ছায়া রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমবিজেড। তার নেতৃত্বে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বেশ সক্রিয়ভাবেই বিচরণ করে দেশটি।
এমবিজেডের নেতৃত্বে সৌদি আরব নিয়ন্ত্রিত হুথি বিদ্রোহী বিরোধী সামরিক জোটের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে ওঠে সংযুক্ত আরব আমিরাত। সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দী ইরানের বিরুদ্ধে এসময় শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায় দেশটিকে। ইসরায়েলের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের একঝাক দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ধারাবাহিকতায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথেও কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয় দেশটির। জানা যায়, এই প্রক্রিয়ার নেপথ্যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল এমবিজেডের।
মোহাম্মদ বিন জায়েদের ‘পরোক্ষ’ শাসনামলে উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তি অর্জন করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সশস্ত্র বাহিনীও। বিশেষ করে প্রচলিত আদি কাঠামোর পরিবর্তে দিন দিন তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর হয়ে ওঠে দেশটির সামরিক বাহিনী।
এমবিজেডের শিক্ষাজীবন কেটেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। পরবর্তীতে ব্রিটেনে সামরিক শিক্ষাও নিয়েছেন তিনি। উদারপন্থী নেতা হিসেবে এমবিজেডের পরিচিতি রয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য শাসকদের মত তিনিও ক্ষমতাসীন রাজপরিবারের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর।
আঞ্চলিক পরিমন্ডলে ইরান বিরোধী অবস্থান এমবিজেডের। মূলত তার এই অবস্থানের কারণেই ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর পথে হেটেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ইয়েমেনে ইরানের সমর্থনপুষ্ট হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে দেশটি। সৌদি আরবের বিতর্কিত যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উত্থানে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন মোহাম্মদ বিন জায়েদ।
নিজের দেশে সংস্কারপন্থী এবং ক্যারিশমেটিক নেতা হিসেবে পরিচিত এমবিজেড একদা আড়ালে থাকা আবু ধাবিকে প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছেন। তিনি এই আমিরাতের শাসকও। দুবাইয়ের মত আবু ধাবিও তেলসম্পদে সমৃদ্ধ ধনী এক আমিরাত। মোহাম্মদ বিন জায়েদের পরিকল্পনায় জ্বালানি, অবকাঠামো ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ব্যাপক সংস্কার করে প্রদেশটিকে পুরো আরব বিশ্বের অন্যতম প্রধান আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থলে পরিণত করা হয়েছে।