ব্রিটেনের রাণী এলিজাবেথ জানিয়েছেন, তিনি চান তার অবর্তমানে প্রিন্স চার্লস যখন দেশের নতুন রাজা হবেন তখন তার স্ত্রী ক্যামিলা পার্কার আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হবেন ‘কুইন কনসোর্ট’ বা ‘রাজপত্নী’ উপাধি দ্বারা।
ব্রিটিশ সিংহাসনে আরোহনের ৭০ বছর পূর্তি তথা প্ল্যাটিনাম জুবিলির প্রাক্কালে দেওয়া এক বার্তায় নিজের এই ইচ্ছার কথা জানান এলিজাবেথ। ব্রিটেনের রাজপরিবারের সুদীর্ঘ ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তিত্ব হিসেবে সিংহাসনে একটানা ৭০ বছর অতিবাহিত করার অন্যন্য রেকর্ড গড়েছেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ২৫ বছর বয়সে ব্রিটেনের রাণী হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছিলেন এলিজাবেথ। সেবছর তার পিতা রাজা পঞ্চম জর্জের আকস্মিক মৃত্যুই এত অল্প বয়সে সিংহাসনে বসিয়েছিল তরুণী এলিজাবেথকে।
তারপর থেকে টানা সাত দশক ব্রিটেন এবং একই সাথে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ আরো কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন রাণী এলিজাবেথ। পুত্রবধু প্রিন্সেস ডায়ানার অকালমৃত্যুর পরের ঘটনাপ্রবাহের মত কিছু ঘটনায় তার ওপর ব্রিটেনবাসী সাময়িক অসন্তুষ্ট হলেও দেশটির আধুনিককালের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজপ্রধান হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকেন এলিজাবেথ।
সিংহাসনে আরোহনের ৭০ বছর পূর্তির দিনটি রাণী এলিজাবেথ সানড্রিংহাম প্রাসাদে ব্যক্তিগতভাবে পালন করেছেন। দিনটির দেশব্যাপী আনুষ্ঠানিক উদযাপন অনুষ্ঠিত হবে আগামী জুন মাসে।
প্লাটিনাম জুবিলি উপলক্ষে দেওয়া এক লিখিত বিবৃতিতে রাণী এলিজাবেথ বলেন, “এই দিনটিকে আমি যতটা স্মরণ করি আমার রাজত্বের সূচনালগ্ন হিসেবে, ততটাই আমার পিতা রাজা পঞ্চম জর্জের প্রয়াণের কারণেও।”
জনগণের উদ্দেশ্যে ৯৫ বছর বয়সী এলিজাবেথ বলেন, “আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই আমাকে ক্রমাগত সমর্থন করে যাওয়ার জন্য। যে আনুগত্য ও ভালোবাসা আপনারা আমার প্রতি দেখিয়েছেন তার জন্য আমি সর্বদা কৃতজ্ঞ।”
সিংহাসনে আরোহনের বিশেষ এই দিনটি এবার রাণী এলিজাবেথের জন্য একটু আলাদা। কারণ এবারই প্রথম স্বামী প্রিন্স ফিলিপকে ছাড়া দিনটি পালন করছেন তিনি। গত বছর ৯৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন ফিলিপ। ১৯৪৭ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এলিজাবেথ ও ফিলিপ। এর পাচ বছর পরই রাণী হিসেবে সিংহাসনে বসেন এলিজাবেথ। এরপর থেকে প্রতিবছরই দিনটির সকল আয়োজনে স্ত্রী’র পাশে থেকেছেন প্রিন্স ফিলিপ, এবারই ব্যতিক্রম।
প্রয়াত স্বামীকে স্মরণ করে রাণী এলিজাবেথ তার বার্তায় প্রিন্স ফিলিপ কতটা নিঃস্বার্থভাবে তাকে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন তাও উল্লেখ করেন।
রাণী এলিজাবেথের ৭০ বছরের শাসনকালে ব্রিটেনের মোট ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী তার অধীনে সরকার পরিচালনা করেছেন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন রাণীর ক্ষমতারোহনের সাত দশক পূর্তি উপলক্ষে টুইটারে দেওয়া এক শুভেচ্ছা বার্তায় লিখেছেন, “তার (রাণী এলিজাবেথের) এত বছরের দায়িত্ব পালনের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। পুরো জাতির সাথে আমিও ঐতিহাসিক এই উপলক্ষ উদযাপনের জন্য অপেক্ষা করছি।”
সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং ডেভিড ক্যামেরনও আলাদা আলাদা বার্তায় শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রাণী এলিজাবেথকে।
ব্রিটিশ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা কেইর স্টারমার রাণীকে তার ৭০ বছরের ‘অতুলনীয় জনসেবার’ জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
এদিকে নিজের রাজ অভিষেকের প্লাটিনাম জুবিলি উপলক্ষে দেওয়া রাণী এলিজাবেথের বিবৃতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচনার জন্ম দিয়েছে চার্লসপত্নী ক্যামিলা পার্কারের ভবিষ্যৎ পরিচয়ের ব্যাপারে নেওয়া তার সিদ্ধান্তটি। প্রিন্স চার্লসের সাথে তার প্রথম স্ত্রী প্রিন্সেস ডায়ানার বিবাহ বিচ্ছেদের পর অনেকেই এই ঘটনার জন্য ক্যামিলা পার্কারকে দায়ী করতেন। বলা হয়, চার্লসের সাথে ক্যামিলার সম্পর্কের কারণেই বিচ্ছেদের পথে হাটতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রিন্সেস ডায়ানা।
এর কয়েক বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে প্যারিসে এক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান ডায়ানা। ব্রিটিশ সমাজ এমনকি বহির্বিশ্বেও তুমুল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ডায়ানার সেই অকালমৃত্য ক্যামিলা পার্কারকে আরও অপ্রিয় করে তোলে ব্রিটেনবাসীর মনে।
একারণেই এতদিন ধারণা করা হত প্রিন্স চার্লস ভবিষ্যৎে রাজা হলে জনঅসন্তোষ এড়াতে তার স্ত্রী ক্যামিলাকে ‘কুইন কনসোর্টের’ পরিবর্তে ‘প্রিন্সেস কনসোর্ট’ উপাধি দেওয়া হবে। ক্ষমতাসীন রাজার স্ত্রীকে ‘কুইন কনসোর্ট’ নামে ডাকা হয় যা প্রকারান্তরে ‘রাণী’ পরিচয়েরই ভিন্নরূপ।
তবে অতীতে সমালোচনার শিকার হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটিশ জনগণের কাছে ক্যামিলা পার্কারের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই বেড়েছে। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের পাশাপাশি রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাণী এলিজাবেথ কিংবা প্রিন্স চার্লসের সাথে সপ্রতিভভাবে অংশ নিতে দেখা যায় তাকে।
রাজপ্রাসাদ সূত্রে জানা যায়, রাণী এলিজাবেথ যথেষ্ঠই পছন্দ করেন ৭৪ বছর বয়সী ক্যামিলা পার্কারকে। ডায়ানার দুই সন্তান প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারির সাথেও ক্যামিলার সম্পর্ক বেশ স্বাভাবিক। এসব কারণেই ক্যামিলা পার্কারকে আর ‘প্রিন্সেস কনসোর্ট’ নয়, বরং সরাসরি ‘কুইন কনসোর্ট’ হিসেবেই মনোনীত করে গেলেন রাণী এলিজাবেথ।