ইউক্রেন-রাশিয়া চলমান উত্তেজনার মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দাবি করেছেন, ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ মহাদেশে সবচেয়ে বড় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে মস্কো।
প্রধানমন্ত্রী বরিস বলেছেন, ইউক্রেন দখলে রাশিয়ার মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরই মধ্যে শুরুও হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, মস্কোর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা হবে বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছেঁ।
মিউনিখে অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা সম্মেলনের ফাঁকে সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। বার্ষিক এই সম্মেলনটি পূর্বনির্ধারিত হলেও সাম্প্রতিক ইউক্রেন ইস্যুর কারণে এটি বিশ্বব্যাপী আলাদা গুরুত্ব পেয়েছে। বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণ নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কড়া সমালোচনা করেছেন।
কয়েক সপ্তাহ আগে ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া বিপুল সংখ্যক সেনা ও যুদ্ধ সরঞ্জাম জড়ো করার পর থেকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক মহলে। ক্রেমলিনের বক্তব্য ছিল, নিয়মিত সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবেই তাদের এই সেনা সমাবেশ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলোর দাবি, ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দেশটি দখল করে রাশিয়ার সাথে একীভূত করাই ভ্লাদিমির পুতিনের লক্ষ্য। আর তা বাস্তবায়নের জন্যই সামরিক মহড়ার অজুহাতে সীমান্তে বিপুল সেনার সমাবেশ ঘটানো হয়েছে।
সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের সীমান্তে এই মূহুর্তে ১৭০,০০০ থেকে ১৯০,০০০ রুশ সেনা ও মস্কোপন্থী বিদ্রোহীরা অবস্থান করছে। এদের মধ্যে একটা অংশ ইউক্রেনের আরেক প্রতিবেশী বেলারুশে মোতায়েন রয়েছে।
বেলারুশের বর্তমান শাসক আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো মস্কোপন্থী এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনের অনুগত হিসেবে পরিচিত। তার এই অবস্থানের কারণেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যেকোনো সামরিক অভিযানে বেলারুশের ভূমি ব্যবহারের সুযোগ পাবেন ভ্লাদিমির পুতিন। এরই মধ্যে বেলারুশে বিপুল সংখ্যক সেনা ও ভারি যুদ্ধাস্ত্র পাঠিয়েছে রাশিয়া। যদিও মস্কোর দাবি, বেলারুশের সাথে পূর্বনির্ধারিত যৌথ সামরিক অনুশীলনের জন্যই দেশটিতে নিজেদের সৈন্য ও সরঞ্জাম পাঠিয়েছে তারা।
ভৌগোলিকভাবে ইউক্রেনের একদিকে রয়েছে বন্ধুভাবাপন্ন ইউরোপ, একদিকে রয়েছে বেলারুশ, একদিকে রাশিয়া আর একদিকে রয়েছে সাগর ও ক্রিমিয়া উপদ্বীপ। এই ক্রিমিয়া একসময় ইউক্রেনের অন্তর্গত হলেও ২০১৪ সালে উপদ্বীপটি দখল করে নেয় রাশিয়া।
পশ্চিমাদের আশঙ্কা, এবার আর ক্রিমিয়ার মত কোন অংশ নয়, পুরো ইউক্রেনই দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন।
সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন মন্তব্য করেন, ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে ঘটা সম্ভাব্য যেকোনো যুদ্ধ বিপুল প্রাণহানি ও রক্তপাত ডেকে আনবে। প্রেসিডেন্ট পুতিন এই ধ্বংসাত্মক দিকটি না ভেবে কেবল (ইউক্রেন দখলের) অযৌক্তিক চিন্তা করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ তার।
তবে পুতিন তার লক্ষ্যে অবিচল থেকে সত্যিই ইউক্রেনে আগ্রাসন চালালে পশ্চিমাদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেব্যাপারে বরিস বলেন, তার দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোরতম অর্থনৈতিক অবরোধ জারি করবে। আরেকটু স্পষ্ট ধারণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাশিয়ার কোম্পানিগুলোকে মার্কিন ডলার ও ব্রিটিশ পাউন্ডে লেনদেন করতে দেওয়া হবেনা। এই সিদ্ধান্ত রাশিয়ার অর্থনীতিকে ‘খুব শক্ত’ আঘাত করবে বলে দাবি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর।
বরিস জনসনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রাশিয়া কি সত্যি সত্যিই ইউক্রেন দখল করতে চলেছে? উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন পর্যন্ত যা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতে আশঙ্কা করছি পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে।
বরিস জনসন আরও বলেন, রাশিয়া মনে করছে ইউক্রেনে হামলা চালালে পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটো দূর্বল হয়ে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে ঘটবে উল্টোটা। ন্যাটোর সদস্যরা আরো ঐক্যবদ্ধ হবে। কারণ তারা বিশ্বের সামনে ‘জোর যার মুল্লক তার’ প্রমাণ হতে দেবেনা। তারা ঐক্যবদ্ধ থেকে রাশিয়াকে সম্ভাব্য সকল জবাবই দেবে।
ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। দেশটি বহু বছর ধরেই সামরিক জোটটির সদস্য হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ন্যাটোর সদস্যদেরও জোটটিতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আপত্তি নেই। নিকট ভবিষ্যৎেই ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মূলত এই কারণেই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রাশিয়া। একসময়ের সোভিয়েত বিরোধী জোট ন্যাটোকে বর্তমান রাশিয়ারও শত্রু হিসেবে দেখে ক্রেমলিন। আর সেই জোটে প্রতিবেশী ইউক্রেনের যোগদানকে কোনোভাবেই মেনে নিতে রাজি নয় মস্কো।
ধারণা করা হচ্ছে, এই নিয়ে দরকষাকষির উদ্দেশ্যেই ইউক্রেন সীমান্তে বিপুল সমরসজ্জার আয়োজন করেছে রাশিয়া। তাদের লক্ষ্য ইউক্রেন দখলের ভয় দেখিয়ে ন্যাটোতে দেশটির অন্তর্ভূক্তি ঠেকানো। তবে শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব না হলে তারা ইউক্রেনকে দখল করে রাশিয়ার সাথে একীভূত করে নিতে চাইবে। কারণ ইউক্রেনের অস্তিত্বই না থাকলে দেশটির ন্যাটোর সদস্য হওয়ারও আর প্রশ্ন থাকবেনা।