ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর পথে আরও একধাপ এগোল রাশিয়া। ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তবর্তী দুই প্রদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত দিয়েছে দেশটি।
দোনেস্ক ও লুহানস্ক প্রদেশ দু’টির উল্লেখযোগ্য অংশ এতদিন রুশপন্থী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। গতকাল এই বিদ্রোহীদের পক্ষ থেকে প্রদেশ দু’টিকে ‘স্বাধীন’ হিসেবে ঘোষণার জন্য ভ্লামিদির পুতিনকে আনুরোধ জানানো হয়।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের আজকের ঘোষণার মধ্য দিয়ে চলমান রুশ-ইউক্রেন সংকট তীব্র আকার ধারণ করতে চলেছে। এতদিন মহড়ার নামে ইউক্রেন সীমান্তে বিপুল সংখ্যক সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম জড়ো করে এলেও সরাসরি দেশটিতে প্রবেশের চেষ্টা চালায়নি রাশিয়া।
এবার ইউক্রেনের দুই প্রদেশকে ‘স্বাধীন’ ঘোষণার মাধ্যমে সেই পথও তৈরি করে নিল মস্কো। তাদের চোখে যেহেতু প্রদেশ দু’টি আর ইউক্রেনের অংশ নয়, ফলে সেখানে ইউক্রেনীয় সেনাদের উপস্থিতিকে ‘অবৈধ’ আখ্যা দেবে ক্রেমলিন। আর সেই ‘অবৈধ সেনাদের দখলদারিত্ব’ থেকে দুই প্রদেশকে ‘মুক্ত করার উদ্দেশ্যে’ সেখানে নিজেদের সৈন্যবাহিনী প্রবেশ করাবে রাশিয়া।
আর তেমনটা ঘটলে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখলের পর প্রথমবারের মত ইউক্রেনের ভূখন্ডে ঢুকে পড়বে রাশিয়ার বাহিনী, যা কার্যত হবে দেশটির সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। আর দোনেস্ক ও লুহানস্ক প্রদেশে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার পর হয়ত অন্য কোন অজুহাতে ইউক্রেনের বাকি অংশগুলোও দখল করে নেবেন ভ্লাদিমির পুতিন।
দুই প্রদেশকে স্বাধীন হিসেবে রুশ প্রেসিডেন্টের মধ্যরাতের ঘোষণার পরই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক মহলে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলদেমায়ার জেলেনস্কি এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, ইউক্রেন শান্তি চেয়েছিল। কিন্তু আমরা ভয়ও পাইনা এবং আমরা কাউকেই (আমাদের দেশের) কোনকিছুই নিতে দেবনা। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি আন্তর্জাতিক সহযোগীদের কাছে স্পষ্ট ও কার্যকর সহায়তা কামনা করেন।
সোমবার রাতে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ঘন্টাব্যাপী ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন দাবি করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের দ্বারা আধুনিক ইউক্রেনের সূচনা হয়েছিল। দেশটি কোনদিনই স্বার্বভৌম রাষ্ট্র ছিলনা। ইউক্রেনকে ‘প্রাচীন রাশিয়ান ভূখন্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন প্রেসিডেন্ট পুতিন।
তিনি দাবি করেন, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়াকে ‘লুট’ করা হয়েছিল। ইউক্রনের মত রাশিয়ার অনেক কিছুই সেসময় কৌশলে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট।
পুতিন ইউক্রেনকে ‘মার্কিন কলোনি’ আখ্যা দিয়ে দেশটি ‘পুতুল সরকার’ দ্বারা পরিচালিত হয় বলে মন্তব্য করেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে সংঘটিত সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে অভীহিত করেন পুতিন। ঐ আন্দোলনে ইউক্রেনের মস্কোপন্থী সরকারের পতন ঘটছিল যা সেসময় ক্ষুব্ধ করেছিল ক্রেমলিনকে।
ইউক্রেনের জোড়া প্রদেশকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পশ্চিমা দেশগুলো। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একটি আদেশে সাক্ষর করেছেন যাতে ঐ দুই প্রদেশে যেকোনো মার্কিন বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও অর্থায়ন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হোয়াইট হাউজ বলেছে, এই সিদ্ধান্তটি রাশিয়ার জন্য নির্ধারিত সম্ভাব্য সার্বিক নিষেধাজ্ঞার বাইরে, যে নিষেধাজ্ঞা রাশিয়া পুরো ইউক্রেন দখল করে নিলে জারি করা হবে বলে ঠিক করা হয়েছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দুই ইউক্রেনীয় প্রদেশকে স্বাধীনতা দেওয়ার ঘোষণাকে ‘চূড়ান্ত’ অনৈতিক হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, এই ঘটনা ইউক্রেনের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব এবং একই সাথে আন্তর্জাতিক আইনেরও লঙ্ঘন। দেশটির অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, মঙ্গলবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করবে ব্রিটেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়িন ইউক্রেনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে বার্তা দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন দোনেস্ক ও লুহানস্ক প্রদেশে ‘শান্তিরক্ষার’ উদ্দেশ্যে রুশসেনা প্রেরণের ঘোষণাকে নাকচ করে দিয়েছেন।
জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের আগে নিজ দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সাথে দুই প্রদেশকে ‘স্বাধীন’ ঘোষণা করা নিয়ে এক বৈঠক করেন ভ্লাদিমির পুতিন। সেখানে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেকেই তার সিদ্ধান্তের পক্ষে অবস্থান নেন। দু’জন কর্মকর্তা আরও একধাপ এগিয়ে দুই প্রদেশকে রাশিয়ার সাথে একীভূত করার প্রস্তাব দেন, যেমনটা ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের বেলায় করেছিলেন পুতিন।
তবে তাদের এই প্রস্তাবে আপত্তি জানান স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, আমরা প্রদেশ দু’টিকে রাশিয়ার অংশ করার জন্য এই বৈঠক করছিনা, করছি তাদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে কি হবেনা সেটা ঠিক করতে।