সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব এনে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিরোধী দলগুলোর উদ্যোগের মধ্যে সংসদই ভেঙে দিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। আজ প্রধানমন্ত্রী ইমরানের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট আলভি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে ঘোষণা করেছে পাক প্রেসিডেন্টের দপ্তর।
গত সপ্তাহে পাকিস্তানের সংসদে ক্ষমতাসীন পিটিআই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে বিরোধী দলগুলো। ৩৫৪ সদস্যের পাকিস্তান সংসদে কোন সরকারকে টিকে থাকতে হলে এর অর্ধেকের একটি বেশি অর্থাৎ নূন্যতম ১৭২ জন সাংসদের সমর্থন প্রয়োজন হয়। একইভাবে সরকারের বিরুদ্ধে আনা কোন অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করে সরকারের পতন ঘটানোর জন্যও ঐ একই সংখ্যক সাংসদের সমর্থন দরকার।
পাকিস্তানের বর্তমান সংসদে ক্ষমতাসীন পিটিআই দলের সাংসদের সংখ্যা ১৭২ জনের বেশি হলেও তাদের মধ্যে কয়েকজন উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করে সংসদে স্পষ্টভাবেই সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে ইমরান খানের সরকার। তার দলের উদ্যোগে ভিন্নমতাবলম্বী সাংসদদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাদের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে।
এই অবস্থায় সংসদে আনা অনাস্থা প্রস্তাবটি পাশ হয়েই যাবে বলে একপ্রকার নিশ্চিত ছিল বিরোধী দলগুলো, এমনকি সরকার পক্ষও। আজ সকালে প্রস্তাবটির পক্ষে ভোটাভুটির দিন ধার্য থাকলেও অধিবেশন শুরুর পরপরই অনেকটা আকস্মিকভাবে প্রস্তাবটি খারিজ করে দেন সংসদের ডেপুটি স্পিকার। তার দাবি, যথাযথ নিয়ম মেনে অনাস্থা প্রস্তাবটি পেশ করেনি বিরোধীরা।
ডেপুটি স্পিকারের অপ্রত্যাশিত এমন সিদ্ধান্তে স্বভাবতই হতভম্ব হয়ে পড়ে সংসদে উপস্থিত বিরোধী দলগুলোর সাংসদরা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের হতাশা আরও বেড়ে যায় যখন অধিবেশনে অনুপস্থিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে সংসদ ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান। একই সাথে ঘোষণা দেন নতুন সাধারণ নির্বাচনেরও।
এর কিছুক্ষণ পরই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভবনে যান প্রধানমন্ত্রী ইমরান। সেখানে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভিকে সংসদ ভেঙে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানান তিনি। সংবিধান অনুযায়ী, দেশের সংসদ ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র প্রেসিডেন্টের, তবে সেটি তিনি করতে পারেন কেবলমাত্র প্রধানমন্ত্রী পরামর্শেই।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আনুষ্ঠানিক ‘পরামর্শ’ পাওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি বর্তমান সংসদ বিলুপ্ত করে দিয়েছেন।
পাক সংসদে পিটিআই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনাকে শুরু থেকেই ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দাবি করে আসছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ইমরানের অভিযোগ, তার মার্কিন স্বার্থবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির কারণেই যুক্তরাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, তার দলের কিছু সাংসদকে কিনে নিয়ে, বিরোধী দলগুলোকে দিয়ে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো ইমরানের এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার শাসনামলে প্রায়শই ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ সহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সমালোচনা করেছেন। পূর্বতন পাক প্রধানমন্ত্রীদের মত তিনিও চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করেছেন। এছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু পরপরই আকস্মিক মস্কো সফর করে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে বৈঠক করে এসেছেন।
ফলে ইমরান খানের সরকারের পতনে যুক্তরাষ্ট্রের হাত থাকুক বা না থাকুক, পিটিআই প্রধান যে দেশটির প্রিয়পাত্র ছিলেননা সেব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে জিতে ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, তখন বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ ছিল, দেশটির প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর আনুকূল্যেই ক্ষমতায় যেতে পেরেছেন সাবেক ক্রিকেট অধিনায়ক। এমনকি অনেক গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরও মত ছিল তেমনই, যদিও তা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন পাক প্রধানমন্ত্রী।
তবে ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই নানা ইস্যুতে সেনাবাহিনীর সাথে ইমরান খানের মতবিরোধের খবর আসতে শুরু করে। সর্বশেষ দেশটির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ এর প্রধান নিয়োগকে কেন্দ্র করে এই দূরত্ব চরম আকার নেয়। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর অবস্থানের বিপরীতমুখী বক্তব্য দেন সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া।
এমন প্রেক্ষাপটে ইমরানের দল পিটিআই এর কয়েকজন সাংসদ আকস্মিকভাবে সরকার বিরোধী অবস্থান নেন। এতে সরকার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে বলে দাবি করে বিরোধী দলগুলো। তারা সরকারের বিরুদ্ধে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে। তবে শেষ পর্যন্ত অনেক নাটকীয়তার পর আজ তা খারিজ করে দিলেন সংসদের ডেপুটি স্পিকার। আর সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।
ক্ষুব্ধ বিরোধী দলগুলো এরই মধ্যে আদালতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সরকারি ভবনগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। রাজধানী ইসলামাবাদে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনী।
পাকিস্তানের ইতিহাসে এর আগে ১৯৮৯ ও ২০০৬ সালেও ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল তৎকালীন বিরোধী দলগুলো। তবে দু’বারই অনাস্থা ভোটে জিতে ক্ষমতা ধরে রাখতে সমর্থ হন ঐ দুই সময়ের দুই প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও শওকত আজিজ।