নাটকীয়তায় ভরা একটা সপ্তাহের পর পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হলেন বিরোধীদলীয় নেতা ও দেশটির পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ।
গত সপ্তাহে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে উত্থাপিত অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তার স্থলাভিষিক্ত কে হবেন তা নির্ধারণে আজ অধিবেশনে বসে পাক পার্লামেন্ট। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ভোটে পাকিস্তানের ২৩ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন শাহবাজ, যিনি দেশটির আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সহোদর।
পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী প্রাক্তন ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খানের দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (পিটিআই) ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন ইমরান খান। ২০২৩ সালে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার কথা ছিল ইমরান খানের পিটিআই সরকারের।
ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে নানা উদ্যোগ নেয় পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো। সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফের দল ‘পাকিস্তান পিপলস পার্টি’ ও ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগ’ সহ সম্মিলিত বিরোধীদল লংমার্চ, সভা-সমাবেশ, র্যালিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পার্লামেন্টের ভেতরে, বাইরে প্রধানমন্ত্রী ইমরানের বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকে।
সর্বশেষ কয়েক সপ্তাহ আগে পার্লামেন্টে পিটিআই সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার ঘোষণা দেয় বিরোধী দলগুলো। এসময় জান্স যায়, ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন সংসদ দদস্যও অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিতে যাচ্ছেন।
এই প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অভিযোগ করেন, বিদেশি শক্তি তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতেই তার দলের কিছু সাংসদকে পক্ষত্যাগ করিয়ে অনাস্থা প্রস্তাবের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টা করছে। নাম না করলেও ইমরানের ইশারা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকান্ডের সমালোচনা, চীন ও রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠতাসহ নানা ইস্যুতে ইমরানের প্রতি মার্কিন প্রশাসন বিরাগভাজন ছিল বলে মনে করা হয়।
বিরোধী আনা ঐ অনাস্থা প্রস্তাব ঘিরে চরম নাটকীয়তা দেখা দেয় পাক রাজনীতিতে। সংখ্যার বিচারে ইমরান খানের সরকারের পতন যখন প্রায় নিশ্চিত, তখনই প্রথমে সংসদের ডেপুটি স্পিকার অনাস্থা প্রস্তাবটি খারিজ দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী ইমরান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেন। তার ধারাবাহিকতায় দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভী পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করেন।
সরকারপক্ষের একের পর এক এসব অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপে বিরোধীরা শুরুতে হতভম্ব হয়ে গেলেও দ্রুতই তারা আদালতের শরাণাপন্ন হন। দেশটির সুপ্রিম কোর্ট বিরোধীদের পক্ষে রায় দিয়ে পার্লামেন্ট পুনর্বহাল ও সেখানে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটির নির্দেশ দেয়।
আদালতের নির্দেশনামত গত সপ্তাহে পুনরায় সংসদের অধিবেশন বসে এবং অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদ অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলে পতন ঘটে পিটিআই সরকারের, ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান খান।
ইমরানের বিদায়ের পরপরই নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের উদ্যোগ নেয় বিরোধীরা। তাদের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে আগে থেকেই মনোনীত ছিলেন শাহবাজ শরিফ। অন্যদিকে ইমরানের দলের পক্ষে প্রার্থী হন পিটিআই সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি।
তবে একেবারে শেষ মূহুর্তে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয় পিটিআই। দলটির সংসদ সদস্যরা অধিবেশন থেকে ওয়াকআউট করেন। এরপর পার্লামেন্ট থেকেই একে একে পদত্যাগ করেন ইমরান খান সহ পিটিআইয়ের সকল সাংসদ।
পিটিআই বিহীন পার্লামেন্টে নিজেদের ১৭৪ জন সাংসদের ভোটে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শাহবাজ শরিফ। ৩৪২ সদস্যের পাক পার্লামেন্টে কমপক্ষে ১৭২ সাংসদের সমর্থন প্রয়োজন হয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সংসদে দেওয়া ভাষণে শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের অর্থনীতির দূর্দশাকর অবস্থার জন্য তার পুর্বসূরী ইমরান খানকে দায়ী করেন। শাহবাজ বলেন, অর্থনীতিকে আবার সঠিক পথে আনা তার সরকারের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ হবে।
এদিকে ক্ষমতা হারালেও রাজনীতির মাঠ ছাড়ছেননা ইমরান খান। তার সরকারের পতনের পর থেকেই গোটা পাকিস্তান জুড়ে বিক্ষোভ দেখিয়ে আসছে পিটিআইয়ের কর্মী সমর্থকেরা। ইমরান নিজেও বেশ কয়েকটি বড় শহরে আয়োজিত প্রতিবাদ সভায় সশরীরে যোগ দিয়েছেন।