১৯৪৫ সালের এই দিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল হিটলারের নাৎসি জার্মানি। আত্মসমর্পণের দলিল যখন কার্যকর হয়, ঘড়ির কাটার পার্থক্যের কারণে ইউরোপে তখন তারিখটা ৮ মে ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে ৯ মে। একারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় দিবস ইউরোপের দেশগুলোতে ৮ মে ও বর্তমান রাশিয়ায় ৯ মে পালিত হয়।
রাশিয়ায় বহু বছর ধরেই বেশ আড়ম্বরের সাথে ঐতিহাসিক এই দিনটি উদযাপন করা হয়। বিজয় দিবসে দেশটির প্রধান আকর্ষণ মস্কোর রেড স্কয়ারে আয়োজিত বর্ণাঢ্য সামরিক কুচকাওয়াজ। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের উপস্থিতিতে দেশটির সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সামরিক শক্তিমত্তা বেশ জোরেশোরে প্রদর্শন করা হয় এতে।
এবছর সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে আয়োজিত হতে যাচ্ছে রাশিয়ার বার্ষিক এই কুচকাওয়াজ। দু’মাস আগে প্রতিবেশী ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করেছিল মস্কো। ধারণা করা হয়েছিল, খুব সহজেই রাজধানী কিয়েভসহ পুরো ইউক্রেন দখল করে নিতে পারবে রাশিয়া। কিন্তু বাস্তবে সেখানে বড় ধরনের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছে রুশ বাহিনীকে। এখন পর্যন্ত পূর্ব ইউক্রেনের কিছু অঞ্চল ছাড়া দেশটির কোথাওই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি রাশিয়ার সেনারা।
এই অবস্থায় ৯ মে মস্কোর কুচকাওয়াজ পূর্ব ভাষণে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেন অভিযান নিয়ে বড় ধরনের কোন ঘোষণা করতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। কোনো সূত্র বলছে, তিনি এদিন যুদ্ধে কোন এক প্রকার বিজয়ের ঘোষণা দিতে পারেন, সেক্ষেত্রে ইউক্রেনের পূর্বাংশ রুশ নিয়ন্ত্রণে আনাকেই ‘অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল’ বলে দাবি করতে পারেন তিনি।
আবার আরেকটি সূত্র বলছে, পুতিন সেদিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের ঘোষণা দিতে পারেন। রাশিয়া এতদিন ইউক্রেনে যুদ্ধ নয়, বরং ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ চালানোর কথা বলে এসেছে। এরূপ অভিযানের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন চাইলেও বিপুল সংখ্যক সেনা (বিশেষ করে সংরক্ষিত বাহিনী) অভিযানস্থলে পাঠানো যায়না।
পুরোদস্তুর যুদ্ধ ঘোষণা করলে, যেকোনো সংখ্যায় সেনা ও সরঞ্জাম সংসদ বা কারো কাছে জবাবদিহিতা ছাড়াই যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে সরবরাহ করা যায়। যেহেতু প্রায় দু’লক্ষ সেনা পাঠিয়েও ইউক্রেনে প্রত্যাশিত ফলাফল পেতে ব্যর্থ হয়েছে ক্রেমলিন, তাই এখন আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের ডাক দিয়ে নিজেদের সামরিক শক্তির সর্বোচ্চটুকু ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে পারেন ভ্লাদিমির পুতিন।
২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে মিসাইল হামলার মধ্য দিয়ে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করেছিল রাশিয়া। এর কয়েক ঘন্টা পর দেশটিতে ঢুকতে শুরু করে রুশ সেনারা। তবে ইউক্রেনের অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধের কারণে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়তে অনেকটা সময় লেগে যায় তাদের। একসময় রাজধানী কিয়েভের উপকন্ঠে পৌছলেও প্রতিরোধের মুখে ঐ শহরেও ঢুকতে পারেনি তারা।
বেশ কিছুদিন অপেক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাওয়ার পরও পরিস্থিতি অনুকূলে না আসায় এবং ততদিনে কয়েক হাজার রুশ সেনার মৃত্যু ও কয়েকশ ট্যাংক ধ্বংসসহ বিপুল সামরিক ক্ষতির মুখে পড়ে অভিযানে বড়সড় পরিবর্তন আনে ক্রেমলিন।
ইউক্রেনের বাকি সব এলাকা থেকে সেনাদের সরিয়ে এনে দেশটির পূর্ব অংশে জড়ো করা হয়। পুরো ইউক্রেন দখল করতে না পারলে অন্তত দনবাস প্রদেশসহ রুশ সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউক্রেনের যতটা সম্ভব এলাকা কব্জা করার কৌশল নেয় রাশিয়া, যাতে যুদ্ধ থেকে একেবারে খালি হাতে ফিরতে না হয় প্রেসিডেন্ট পুতিনকে।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ একপ্রকার বিনা বাধায় দখল ও রাশিয়ার সাথে একীভূত করার ঘটনায় নিজ দেশে পুতিনের জনপ্রিয়তা এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। ৮ বছর পর একই কায়দায় পুরো ইউক্রেন দখল করে নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও অন্তত এখন পর্যন্ত সে মিশনে অসফল প্রেসিডেন্ট পুতিন।
আর এই আপাত ব্যর্থতা স্থায়ী রূপ নিলে সামনের দিনগুলোতে কড়া রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে পুতিনকে। কারণ তার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে শুরু হওয়া যুদ্ধ থেকে এরই মধ্যে হাজার হাজার রুশ সেনার মরদেহ কফিনবন্দী হয়ে ফিরছে মাতৃভূমিতে। এ নিয়ে ভবিষ্যৎে জনঅসন্তোষ মাথাচাড়া দিলে তা পুতিনের মসনদকে ঝুকির মুখে ফেলতে পারে।
তাই ভ্লাদিমির পুতিন এখন চাইবেন হয় কোন এক কথিত সাফল্যের দাবি করে (হতে পারে ক্রিমিয়ার মত দনবাস, দোনেস্ককেও রাশিয়ার সাথে একীভূত করা) এখনই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে অথবা উল্টো আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে হাতছাড়া হওয়া যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করতে।
আর এ দু’টোর কোনো একটি করার সিদ্ধান্ত জানাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের বার্ষিকীর চেয়ে ভালো উপলক্ষ্য আর কী হতে পারে! তাই এখন দেখার অপেক্ষা ৯ মে সামরিক কুচকাওয়াজে দেওয়া ভাষণে এমন কোন ঘোষণা রুশ প্রেসিডেন্ট দেন কিনা।