ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকায় গত কয়েক মাস ধরে চলা অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংকটের জেরে ক্ষমতায় থাকা রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করেছে।
পরিস্থিতি সম্প্রতি দেশটির সরকারের নিয়ন্ত্রণের প্রায় বাইরে চলে যায়। রাজধানী কলম্বোয় সরকার সমর্থকদের সাথে বিক্ষোভকারীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ৫ জন নিহত এবং প্রায় দুইশত লোক আহত হন। নিহতদের মধ্যে সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্যও রয়েছেন।
আরেক ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের বাসভবনে হামলা চালায় আন্দোলনকারীরা। তারা কয়েকটি ভবন ও গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এর পরপরই দেশেজুড়ে কারফিউ জারি করে শ্রীলংকা সরকার। রাজধানীর বাইরেও বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে বিক্ষুব্ধরা।
১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলংকা। আর এই পরিস্থিতির জন্য ২০০৫ সাল থেকে পালাক্রমে দেশটির শীর্ষ পদে থাকা দুই ভাই মাহিন্দা ও গোতাভায়া রাজাপাকসের সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হয়ে আসছে।
একারণেই চলমান গণবিক্ষোভের শুরু থেকেই আন্দোলনকারীদের প্রধান দাবি ছিল প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে গোতাভায়া ও মাহিন্দার সরে দাড়ানো।
আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শ্রীলংকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে গত মাসে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ছাড়া দেশটির মন্ত্রীসভার বাকি সব সদস্য একযোগে পদত্যাগপত্র জমা দেন প্রেসিডেন্টের কাছে। তাদের মধ্যে মাহিন্দার ছেলে নামাল সহ রাজাপাকসে পরিবারের কয়েকজন সদস্যও ছিলেন।
এরপর ক্ষমতাসীনসহ আরও কয়েকটি দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে কথিত জাতীয় সরকার গঠন করেন প্রেসিডেন্ট গোতাভায়া। সে সরকারেরও প্রধানমন্ত্রী থাকেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হলে ঐ সরকারে যোগ দেয়নি শ্রীলংকার প্রধান বিরোধী দলগুলো।
প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর একের পর এক নেওয়া এসব পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজপথে চলমান রাজাপাকসে বিরোধী আন্দোলনকে দূর্বল করে দেওয়া। তবে সে ফাদে পা না দিয়ে ক্ষমতা থেকে রাজাপাকসে ভাইদের আপসারণের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যায় বিক্ষোভকারীরা।
পরিস্থিতি দিনকে দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকায় এবং সর্বশেষ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন আক্রান্ত হওয়ায় ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি হন মাহিন্দা রাজাপাকসে। সহোদর গোতাভায়ার কাছে আজ নিজের পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন ৭৬ বছর বয়সী মাহিন্দা রাজাপাকসে।
তবে মাহিন্দার পদত্যাগেও শ্রীলংকার পরিস্থিতি শান্ত হবে বলে মনে করছেননা বিশ্লেষকরা। কারণ শুধু প্রধানমন্ত্রী নয়, প্রেসিডেন্টেরও পদত্যাগ দাবি করে আসছেন আন্দোলনকারীরা। ফলে গোতাভায়া রাজাপাকসেও সরে না দাঁড়ানো পর্যন্ত চলমান বিক্ষোভ অব্যাহত থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সোমবার যখন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা, সেসময় অনুগতদের নিয়ে ভেতরেই ছিলেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। আন্দোলনকারীরা বাসভবনের ভেতরের সুরক্ষা বলয় পর্যন্ত পৌছে গেলে তাদের নিবৃত্ত করতে যথেষ্ঠ বেগ পেতে হয় নিরাপত্তা বাহিনীকে।
এর আগে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বাইরে সংঘটিত সহিংসতার জেরে সেসব স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ ও সেনা সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছিল।
এদিকে কলম্বোর বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সম্প্রতি সরকার সমর্থকদের হামলার ঘটনায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে উঠেছে। এতদিন আন্দোলনে পুলিশ বাধা দিলেও সরকারপন্থীদের কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি।
এদিকে বিক্ষোভকেন্দ্রিক সহিংসতায় আজ প্রাণ হারিয়েছেন সরকারদলীয় এক জন সংসদ সদস্য। রাজধানীর অদূরে নিত্তামবুয়া শহরে এই ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা গেছে, ঐ সাংসদকে দেখতে পেয়ে তার গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ শুরু করে আন্দোলনকারীরা।
এসময় সাংসদ নিজের পিস্তল দিয়ে বিক্ষোভকারীদের দিকে গুলি ছুড়লে একজন মারা যান। এর কিছুক্ষণ পর ঐ সাংসদকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় বলে জানান তার দেহরক্ষী।
অনুরূপ আরেক ঘটনায় দেশটির ওয়েরাকেতিয়া শহরে আরেক সরকারদলীয় সাংসদের গুলিতে দু’জন নিহত ও পাচজন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।