এরই মধ্যে সারা বিশ্ব জেনে গেছে, প্রায় এক লক্ষ সেনা নিয়ে ইউক্রেনের সীমান্তে পুরোদস্তুর এক সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি প্রায় শেষ করে এনেছে রাশিয়া। দেশটি যদিও দাবি করছে ইউক্রেনে হামলা চালাতে নয় বরং নিজেদের সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবেই তাদের এই তৎপরতা।
কিন্তু রাশিয়ার এই দাবিকে একেবারেই বিশ্বাস করছেনা পশ্চিমা বিশ্ব। এমনকি রাশিয়ার মিত্ররাও একপ্রকার নিশ্চিত, ইউক্রেনে অভিযানই মস্কোর এত বিশাল সমর আয়োজনের একমাত্র উদ্দেশ্য।
রাশিয়ার সম্ভাব্য এই হামলার জবাব যদি ইউক্রেন দেয় এবং প্রত্যাঘাত করে, তাহলে সামরিক অভিযানটি কেবল অভিযানে সীমাবদ্ধ থাকবেনা, পরিণত হবে পুরোদস্তুর যুদ্ধে। আর ইউক্রেনের দিকে ন্যাটোর মিত্ররাও যদি সামরিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে সেই যুদ্ধের তীব্রতা কতটা মারাত্মক হবে তা সহজেই অনুমেয়।
তাই রাশিয়া যদি সত্যি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালাতে চায়, তাহলে দেশটিকে কেবল ইউক্রেন নয়, তার সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ তথা পুরো ন্যাটোর মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিয়েই অভিযান শুরু করতে হবে। বাস্তবেও দেশটি করছে তাই।
এখন এক এক করে দেখা যাক ঠিক কি পরিমান সৈন্য এবং সমরাস্ত্র নিয়ে ইউক্রেন অভিমুখে অবস্থান নিয়েছে ক্রেমলিন।
প্রায় ৩৫,০০০ সেনা আগে থেকেই ইউক্রেনের সীমান্ত এলাকাগুলোতে মোতায়েন ছিল। সাম্প্রতিক তৎপরতায় এই সংখ্যা আরও বাড়তে বাড়তে এখন প্রায় ১০০,০০০ হয়ে দাড়িয়েছে। এদের মধ্যে সেনাদলের বেশকিছু ইউনিটকে রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি ৪,০০০ মাইল দূর থেকেও এনে জড়ো করা হয়েছে।
ইউক্রেনের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করা হয়েছে, এই মূহুর্তে রুশ সেনাবাহিনীর ১০৬,০০০ সদস্য এবং নৌ ও বিমান বাহিনীর আরও ২১,০০০ সদস্য সীমান্ত এলাকাগুলোতে অবস্থান নিয়ে আছে।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গতকাল গোয়েন্দা সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছেন, রুশ সামরিক বাহিনীর ৬০টি ইউনিট বর্তমানে ইউক্রেন সীমান্তে রয়েছে। আয়তনের হিসেবে যা বাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ।
সেনাবাহিনীর নিয়মিত এসব সদস্যের বাইরেও লুহানস্ক ও দোনেৎস্কের মত ইউক্রেনের অভ্যন্তরের সীমান্ত এলাকাগুলোতে প্রায় ১৫,০০০ রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদী সক্রিয় রয়েছে।
সীমান্তের যেসব এলাকায় রুশ সৈন্যরা ঘাটি গেড়ে রয়েছে, সেসব জায়গার স্যাটেলাইট চিত্র থেকে সেনাদের অবস্থান সম্পর্কে অনেকটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
অস্থায়ী ছাউনিগুলোতে বিপুল সংখ্যক সামরিক যান দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে বরফের ওপর চাকার দাগ থেকে সামরিক যানবাহনগুলোর নিয়মিত চলাচল বোঝা যাচ্ছে। এছাড়া এসব ঘাটির যেসব তাবুতে সৈন্যরা থাকছেন, সেগুলোর থার্মাল ডিটেকশনের (ওপর থেকে কোন স্থাপনার তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ) মাধ্যমে তাবুগুলোতে কত সংখ্যায় সৈন্য রয়েছেন তার আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে।
বেলারুশে সেনা সমাবেশ
ইউক্রেনের পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমান্তে রয়েছে রাশিয়া আর উত্তরে অবস্থিত বেলারুশ। এই বেলারুশের বর্তমান নেতা আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো দেশটির দীর্ঘ সময়ের স্বৈরশাসক এবং তিনি রুশ ঘনিষ্ঠ। একারণেই ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে তার সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতির জন্য বেলারুশকেও পুরোমাত্রায় কাজে লাগাচ্ছেন।
দেশটির সাথে যৌথ সামরিক মহড়ার নামে এরই মধ্যে কয়েক হাজার সেনাকে বেলারুশে পাঠিয়েছে মস্কো। ১০ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছবে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বেলারুশ সীমান্ত থেকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটারেরও কম।
সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন আলোকচিত্র ও ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, সশস্ত্র সামরিক যান, ট্যাঙ্ক এবং মিসাইল নিক্ষেপ সরঞ্জামের মত রুশ সেনাবাহিনীর ভারী সমরাস্ত্র বহন করা হচ্ছে বেলারুশের অভ্যন্তরে।
রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, উন্নত সু-৩৫ যুদ্ধবিমান, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, গোলাবারুদ এবং চিকিৎসা সহায়তা উপকরণ বেলারুশে পরিচালিত আসন্ন ‘যৌথ মহড়ার’ জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছে।
সমুদ্রের প্রস্তুতি
রাশিয়া বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিশেষ নৌ মহড়ার আয়োজন করেছে। যুদ্ধজাহাজসহ ১৪০টি নৌযান, ৬০টি বিমান এবং প্রায় ১০,০০০ সদস্য এগুলোতে অংশ নেবেন। আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত ছড়ানো এসব মহড়া এমাসে শুরু হয়ে পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়ে চলবে। ভূমধ্যসাগরের মহড়ায় অংশ নিতে এরই মধ্যে ছয়টি রুশ যুদ্ধজাহাজ ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেছে। এসব জাহাজে করে সৈন্য, ট্যাঙ্ক এবং সশস্ত্র যান পরিবহন করা সম্ভব।
তবে রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন চালালে সমুদ্র উপকূল দিয়ে দেশটিতে প্রবেশের চেষ্টা করবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে সামরিক বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, উপকূলে ইউক্রেনের বাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা রাশিয়ার জন্য সহজ হবেনা। একারণে হয়ত কেবল তিনদিকের স্থলসীমান্ত দিয়েই ইউক্রেনে ঢোকার কথা ভাববে ক্রেমলিন।