শেষ চেষ্টা হিসেবে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়েও ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেননা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। গত সপ্তাহে সংসদে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো। তাদের সাথে হাত মিলিয়ে ইমরান খানের ক্ষমতাসীন দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (পিটিআই) এর কয়েকজন সাংসদও অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পার্লামেন্টে স্পষ্টতই সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে পিটিআই।
এই অবস্থায় সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ তথা সরকার পড়ে যাওয়া ঠেকাতে প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে সংসদই ভেঙে দেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। একই সাথে ঘোষণা দেন সাধারণ নির্বাচনের। এর আগে সংসদে বিরোধী দলগুলোর উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করে দেন ডেপুটি স্পিকার।
ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের একের পর এক এসব সিদ্ধান্তে শুরুতে হতভম্ব হয়ে পড়লেও পরবর্তীতে আদালতের শরণাপন্ন হয় বিরোধী দলগুলো। তার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের শীর্ষ আদালত ডেপুটি স্পিকারের অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করার সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। এছাড়া বিলুপ্ত সংসদকে পুনর্বহালেরও নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। একই সাথে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবটি অবিলম্বে গ্রহণ করে সংসদে এর ওপর ভোটাভুটিরও নির্দেশনা দেয় আদালত।
এরই প্রেক্ষিতে আজ সকালে পুনরায় অধিবেশন বসে পাকিস্তান সংসদের। সারাদিন সরকার পক্ষের সময়ক্ষেপণ ও স্পিকারের কয়েক দফায় অধিবেশন মুলতুবি করার পর শেষমেশ মধ্যরাতে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
সরকারি দল ও বিরোধী দলগুলোর সংসদ সদস্যদের ভোটদানের পর ফলাফল ঘোষণা করেন স্পিকার। আর তাতে ধারণামতই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় ক্ষমতাসীন পিটিআই সরকার। মেয়াদ পূরণের আগেই প্রধানমন্ত্রীত্ব হারান ক্রীড়াবিদ থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট অধিনায়ক ইমরান খান।
পিটিআই সরকারের পতনের পর সংসদের প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ এর সভাপতি শাহবাজ শরিফ একে ‘নতুন সূর্যোদয়’ আখ্যা দিয়ে পাকিস্তানের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে শাহবাজ শরিফই হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানের সর্বশেষ সরকারের মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত। সংবিধান অনুযায়ী শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে বর্তমান বিরোধী দলগুলোর নতুন জোট সরকারও ঐ সময় পর্যন্তই ক্ষমতায় থাকবে। এরপর অনুষ্ঠিত হবে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পাওয়া পাকিস্তানের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোন প্রধানমন্ত্রীই পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ইমরান খানের বেলায়ও সেই রেকর্ড বজায় থাকল। মেয়াদের দেড় বছর বাকি থাকতেই সরে যেতে হল তাকে। অন্যদিকে দেশটির অতীত প্রধানমন্ত্রীদের কেউ সামরিক অভ্যুত্থানের জেরে, কেউ প্রেসিডেন্টের আদেশে, কেউ গণবিক্ষোভের মুখে আবার কেউবা আততায়ীর গুলিতে প্রাণ দিয়ে মসনদ থেকে বিদায় নিলেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে এর আগে কেউ ক্ষমতাচ্যুত হননি। সেদিক থেকে ইমরান খান গড়লেন আরেক রেকর্ড।
পাকিস্তানের ৩৪২ সদস্যবিশিষ্ট সংসদে কোন সরকারকে টিকে থাকার জন্য এর অর্ধেকের চেয়ে একজন বেশি অর্থাৎ নূন্যতম ১৭২ সাংসদের সমর্থন প্রয়োজন হয়। একইভাবে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হলে সেটি পাশ করিয়ে সরকারের পতন ঘটাতেও ঠিক ঐ সংখ্যক সাংসদের সমর্থন দরকার।
ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে আজ ভোট দিয়েছেন পাক পার্লামেন্টের মোট ১৭৪ সদস্য। অর্থাৎ প্রয়োজনের চেয়েও দু’টি ভোট বেশি পড়ে প্রস্তাবের সমর্থনে। ফলে স্বল্প কিন্তু স্পষ্ট ব্যবধানেই ক্ষমতাচ্যুত হয় পিটিআই সরকার।
সদ্যবিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান অনাস্থা প্রস্তাব পাশের আগে থেকেই দাবি করে আসছিলেন ‘বিদেশি শক্তির’ ষড়যন্ত্রে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। নাম না নিলেও তার অভিযোগের নিশানা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। তিন বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে চীন ও রাশিয়া ইস্যুতে তার অবস্থানের কারণেই ইমরান মার্কিন প্রশাসনের বিরাগভাজন ছিলেন বলে দাবি তার সমর্থকদের।
ক্ষমতা হারানোর পর পাকিস্তান জুড়ে প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে পিটিআই। ইমরান খান নিজেও বেশ কিছু শহরে অনুষ্ঠিতব্য বিক্ষোভ সমাবেশে সশরীরে যোগ দেবেন বলে জানা গেছে।