দীর্ঘ এক বছর পর নতুন সরকারের দেখা পেল লেবানন। গত বছর দেশটির রাজধানী বৈরুতে একটি রাসায়নিকের গুদামে স্মরণকালের ভয়াবহতম বিস্ফোরণের পর তীব্র সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেছিল তৎকালীন সরকার। এরপর থেকে অন্তর্বর্তী প্রশাসন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছিল দেশটি।
নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন নাজিব মিকাতি। তিনি লেবাননের সবচেয়ে ধনী নাগরিক। এর আগেও দু’বার তিনি লেবাননের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী মিকাতি ও তার মন্ত্রীসভার সদস্যদের নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক অচলাবস্থার আপাত অবসান হল পশ্চিম এশিয়ার দেশ লেবাননে।
নতুন সরকার এমন এক সময়ে লেবাননের দায়িত্ব নিতে চলেছে, যখন একাধিক গুরুতর সংকটে নিমজ্জিত দেশটি। লেবাননের মুদ্রার মান পড়ে গেছে ব্যাপকভাবে, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি হয়ে পড়েছে লাগামছাড়া, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও ওষুধের সরবরাহ দিন দিন কমছে আর এসবের সাথে রয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে দু’বছর ধরে চলতে থাকা গণবিক্ষোভ।
২০২০ সালের ৪ আগস্ট রাজধানী বৈরুতের একটি বন্দরে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণ ঘটে। আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা মূহুর্তে পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।
সেদিনের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ২০৩ জন, আহতের সংখ্যা ৬,০০০ এর কাছাকাছি। প্রায় কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল ঐ বিস্ফোরণে।
তদন্তে জানা যায়, সেখানকার একটি গুদামে নিয়ম না মেনে বিপুল পরিমান আমোনিয়াম নাইট্রেট বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে মজুদ করে রাখা হয়েছিল। আর তাতেই দূর্ঘটনাবশত ঘটে বিস্ফোরণ।
সেদিনের ঐ ঘটনাটি লেবাননের সার্বিক অনিয়ম ও দূর্নীতির এক প্রতীকে পরিণত হয়। দেশজুড়ে সরকার ও প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পথে নামে সাধারণ মানুষ।
কঠোর বিক্ষোভের মুখে সড়ে দাড়ান লেবাননের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়ান। পদত্যাগ করে তার গোটা মন্ত্রীসভাও। তারপর থেকেই কার্যকর কোন সরকার ছাড়াই পরিচালিত হয়ে আসছিল দেশটি।
জনগণের এই অসন্তোষ অবশ্য দানা বাধছিল ২০১৯ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় থেকেই। এরপর করোনার থাবায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। গত কয়েক মাসে লেবাননি মুদ্রার মূল্যমান পড়ে গেছে ৯০ শতাংশ। এই মূহুর্তে দেশটির তিন-চতুর্থাংশ নাগরিক বাস করছে দারিদ্রসীমার নিচে।
এমন প্রেক্ষাপটে নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে নাজিব মিকাতি বলেছেন যে তার প্রথম অগ্রাধিকার হবে ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল’ (আইএমএফ) এর সাথে আলোচনা করে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজের ব্যবস্থা করা।
ফোর্বসের তালিকা অনুযায়ী লেবাননের এক নম্বর ধনী মিকাতি বলেন, “আমার বিপুল সম্পত্তি থাকা স্বত্তেও আমি জনগণের দারিদ্রের কষ্ট, ক্ষুধার কষ্ট, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার সবটাই অনুভব করতে পারি।”
আগের সরকারের পদত্যাগের পর নতুন সরকার গড়তে লেবাননের দীর্ঘ এক বছর লেগে যাওয়ার পেছনে রয়েছে দেশটিতে বহুদিন ধরে মেনে চলা একটি রীতি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চলা তিক্ত গৃহযুদ্ধের অবসানের পর দেশটিতে জাতিগত সংঘাত ঠেকাতে ও সৌহার্দ্য বজায় রাখতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির একটি ব্যতিক্রমী প্রথা চালু করা হয়েছিল।
ঐ প্রথা অনুযায়ী লেবাননের প্রেসিডেন্ট করা হয় একজন খ্রীষ্টানকে, প্রধানমন্ত্রী হন একজন সুন্নি মুসলমান এবং সংসদের স্পীকার পদে বসেন একজন শিয়া মুসলমান। মন্ত্রীসভার সদস্যদেরও নিয়োগ দেওয়া হয় সব সম্প্রদায়ের মধ্যে ভারসাম্যমূলক প্রতিনিধিত্ব রেখে।
এবারের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এমন ভারসাম্যের ব্যাপারে ঐক্যমত্যে পৌছাতে গিয়েই সরকার গঠনে এতটা বিলম্ব হয় রাজনৈতিক শক্তিগুলোর।