নব্বইয়ের দশকে সংঘটিত কুখ্যাত রুয়ান্ডা গণহত্যার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত থিওনেস বাগোসোরা মারা গেছেন। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালির একটি কারাগারে বন্দী ছিলেন গণহত্যার দায়ে কারাদন্ডপ্রাপ্ত সাবেক এই কর্ণেল। হৃদযন্ত্রের সমস্যার কারণে তাকে মালির রাজধানী বামাকোর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানেই মারা যান ৮০ বছর বয়সী বাগাসোরা।
১৯৯৪ সালের ভয়াবহ ঐ গণহত্যায় ৮০০,০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। গণহত্যার সূত্রপাত সেবছর ৬ এপ্রিল। রুয়ান্ডার তৎকালীন হুতু সম্প্রদায়ভূক্ত প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবায়ারিমানাকে বহনকারী বিমানকে গুলি করে ভূপাতিত করা হয় সেদিন। প্রেসিডেন্টসহ বিমানে থাকা সকলেই নিহত হন।
এই ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে হুতু সম্প্রদায়। প্রেসিডেন্টকে হত্যার জন্য প্রতিপক্ষ তুতসি সম্প্রদায়কে দায়ী করে তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে তারা। মাত্র ১০০ দিনের মধ্যে ৮০০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল তুতসি।
গণহত্যার ঐ সময়ে রুয়ান্ডার সামরিক বাহিনীর অনানুষ্ঠানিক প্রধান ছিলেন থিওনেস বাগোসোরা। মূলত তার পরিকল্পনা এবং নির্দেশেই তুতসিদের নৃশংসভাবে এবং নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছিল।
গণহত্যার কয়েক মাসের মাথায় মধ্য আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুনে পালিয়ে যান বাগোসোরা। কিন্তু সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করে গণহত্যার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি করা হয় আন্তর্জাতিক আদালতে।
২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক আদালত মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং রুয়ান্ডার তৎকালীন বেশ কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিবিদকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে থিওনেস বাগোসোরাকে।
বিচার চলাকালীন বাগোসোরা নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে রুয়ান্ডার সেসময়ের তুতসি অধ্যুষিত সরকারের মিথ্যা প্রচারণা হিসেবে দাবি করেন।
ঐ মামলার রায়ে আন্তর্জাতিক আদালত বাগোসোরাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে। তবে তিন বছর পর বাগোসোরার সাজার মেয়াদ যাবজ্জীবন থেকে কমিয়ে ৩৫ বছরে পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
চলতি বছরের শুরুতে থিওনেস বাগোসোরা নির্ধারিত মেয়াদের আগেই তাকে কারামুক্তি দেওয়ার আবেদন জানিয়েছিলেন। তবে আদালত সেই আবেদন নাকচ করে দেয়। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত কারাদন্ড ভোগ করলে ৮৯ বছর বয়সে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল বাগোসোরার। কিন্তু তার প্রায় এক দশক আগেই মারা গেলেন তিনি।
মালির কোলিকোরো কারাগারে বন্দী ছিলেন বাগোসোরা। রুয়ান্ডা গণহত্যায় জড়িত আরও অনেক দন্ডপ্রাপ্তও সাজা ভোগ করছেন এই কারাগারে।
রুয়ান্ডা গণহত্যার প্রেক্ষাপট
রুয়ান্ডার ৮৫ শতাংশ নাগরিকই হুতু সম্প্রদায়ভুক্ত, বাকিরা তুতসি সম্প্রদায়ের। তবে দীর্ঘ সময় ধরে এই সংখ্যালঘু তুতসিদের রাজবংশই রুয়ান্ডা শাসন করে এসেছে।
১৯৫৯ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ হুতুরা সংঘবদ্ধ হয়ে তুতসি রাজতন্ত্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। হাজার হাজার তুতসি নাগরিক রুয়ান্ডা ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
প্রতিবেশী উগান্ডায় আশ্রয় নেওয়া তুতসিরা ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট’ (আরপিএফ) নামের একটি গেরিলা গোষ্ঠী গড়ে তোলে। এই সংগঠন ১৯৯০ সালে রুয়ান্ডা আক্রমণ করে। পাল্টা প্রতিরোধ করে হুতুরাও। ১৯৯৩ সালে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে আপাত শান্তি ফিরে আসে রুয়ান্ডায়।
কিন্তু পরের বছর ১৯৯৪ সালে একটি হত্যাকান্ডে পাল্টে যায় সবকিছু। সেবছর ৬ এপ্রিল রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবায়ারিমানা এবং বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সাইপ্রিয়ান নাতিরামিরাকে বহনকারী একটি বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। নিহত হন দুই প্রেসিডেন্টই। ঘটনাচক্রে তারা দু’জনেই ছিলেন হুতু সম্প্রদায়ভুক্ত।
স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনায় ক্ষোভে উন্মত্ত হয়ে ওঠে হুতুরা। তারা দুই প্রেসিডেন্টেকে হত্যার জন্য আরপিএফ-কে দায়ী করে। প্রতিশোধের নেশায় তারা ঝাপিয়ে পড়ে সাধারণ তুতসিদের ওপর।
কিভাবে হত্যাযজ্ঞ চলেছিল?
রুয়ান্ডার হুতু সরকার এবং সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্তারা তুতসিদের নামের তালিকা তৈরি করে দেশের জেলায় জেলায় মিলিশিয়াদের কাছে পাঠিয়ে দিত। তারাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে তুতসিদের সপরিবারে হত্যা করত।
এছাড়া রুয়ান্ডার নাগরিকদের পরিচয়পত্রে আগে থেকেই তাদের সম্প্রদায় উল্লেখ থাকত। ফলে পরিচয়পত্র দেখে সহজেই হুতু এবং তুতসিদের আলাদা করা যেত। হুতু মিলিশিয়ারা রাস্তায় রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়ে পরিচয়পত্র দেখে তুতসি নাগরিকদের হত্যা করত।
সরকার নিয়ন্ত্রিত রেডিও-টেলিভিশনে তুতসিদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণার পাশাপাশি তাদেরকে ‘আরশোলার মত শেষ করে দিতে’ উস্কানি দেওয়া হত। এতে প্রলুব্ধ হয়ে অনেক বেসামরিক সাধারণ হুতু নাগরিকও এমনকি নিজেদের প্রতিবেশি তুতসিদের সপরিবারে হত্যা করেছিল সেই সময়।
প্রায় ১০০ দিন ধরে চলা নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞে রুয়ান্ডার প্রায় ৮০০,০০০ নাগরিক নিহত হন। তাদের বেশিরভাগই তুতসি।
কিভাবে থামল গণহত্যা?
তিনমাস ধরে গণহত্যা চলার পর উগান্ডার সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে তুতসিদের বিদ্রোহী সংগঠন ‘রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট’ (আরপিএফ) রুয়ান্ডার একের পর এক এলাকা পাল্টা দখল করে নিতে শুরু করে। ক্রমেই পরিস্থিতি এতদিন গণহত্যার শিকার হতে থাকা তুতসিদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ক’দিন আগেও যে হুতুরা দলে দলে তুতসিদের হত্যা করছিল, তারাই তখন প্রাণভয়ে সদলবলে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে।
৪ জুলাই আরপিএফ রাজধানী কিগালিতে প্রবেশ করলে রুয়ান্ডায় আনুষ্ঠানিকভাবে তুতসিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বন্ধ হয় গণহত্যা। তবে অভিযোগ আছে, আরপিএফ ক্ষমতায় আসার পর গণহত্যার প্রতিশোধ নিতে তুতসিরাও হাজার হাজার হুতুকে নির্বিচারে হত্যা করেছিল।