প্রয়াত হলেন নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী প্রবাদপ্রতিম মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব আর্চবিশপ ডেসমন্ড টূটু। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী এই তারকা ৯০ বছর বয়সে নিজ দেশে মারা যান।
নেলসন ম্যান্ডেলার পর ডেসমন্ড টুটুই ছিলেন দেশটির বর্ণবাদবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের সবচেয়ে পরিচিত মুখ। দক্ষিণ আফ্রিকার তৎকালীন শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত বর্ণবাদী শাসকগোষ্ঠী, যারা ‘আপার্থাইড সরকার’ নামে পরিচিত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের শিকার কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলন সংগঠিত করা এবং তা দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পৌছে দেয়ার পেছনে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন ডেসমন্ড টুটু। ম্যান্ডেলার মত তিনিও এসব কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন অহিংসা ও সংযমের পথে।
স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৪ সালে নোবেল শান্তি পুরষ্কারে ভূষিত হন টুটু।
ডেসমন্ড টুটুর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা। এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, এই ধর্মযাজকের মৃত্যুতে ‘অসাধারণ দক্ষিণ আফ্রিকান’-দের প্রজন্মের আরেক সদস্যের বিদায় ঘটল। আর্চবিশপ টুটু ‘মুক্ত, স্বাধীন দক্ষিণ আফ্রিকা’ বিনির্মাণে সহায়তা করে গেছেন।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার শোকবার্তায় ডেসমন্ড টুটুকে একজন পথপ্রদর্শক এবং ‘নৈতিকতার কম্পাস’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ঘটনাচক্রে টুটুর মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে প্রয়াত হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার আপার্থাইড সরকারের শেষ প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ক। পূর্বতন প্রেসিডেন্টদের চেয়ে তুলনামূলক উদার হিসেবে পরিচিত ক্লার্কের শাসনামলেই দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটে, কারাবন্দী নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পান, প্রথমবারের মত শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দল ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ (এএনসি) বিজয়ী হয় এবং নেলসন ম্যান্ডেলা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের আসনে বসেন।
আর্চবিশপ টুটু তার ভক্ত ও প্রিয়জনদের কাছে ‘দ্য আর্চ’ নামে পরিচিত ছিলেন, বাংলায় যার অর্থ দরজা বা ফটকের খিলান। গোলাপী রঙের ধর্মীয় আলখাল্লা, ছটফটে স্বভাব আর সর্বদা মুখে লেগে থাকা হাসিই ছিল ডেসমন্ড টুটুর ট্রেডমার্ক।
জনসম্মুখে নিজের আবেগ প্রকাশ করতে দ্বিধা করতেননা ডেসমন্ড টুটু। সকলের সামনে কখনো কেদে ফেলেছেন তো কখনো হো হো করে হাসতেন। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় আয়োজিত ফুটবল বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তার নাচ স্মরণে আছে অনেকের।
তবে স্পষ্টবাদী টুটু কখনো কখনো বিরাগভাজনও হয়েছেন অনেকের। এমনকি আপার্থাইড পরবর্তী ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের’ সরকারেরও অনেক নীতি ও পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন টুটু।
মানবাধিকারের জন্য আজীবন লড়াই করা টুটু মূলত ছিলেন একজন খ্রিষ্টীয় ধর্মগুরু। ১৯৬০ সালে তিনি যাজক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি লেসোথোর বিশপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালে নিয়োগ পান জোহানেসবার্গের বিশপ পদে। পরের বছর ১৯৮৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী কেপটাউনের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আর্চবিশপ হিসেবে মনোনীত হন ডেসমন্ড টুটু।
আর্চবিশপের মত গুরুত্বপূর্ণ পদের ক্ষমতা ও প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার নিপীড়িত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের পক্ষে জোরালো মতামত ব্যক্ত করতে থাকেন। এনিয়ে শ্বেতাঙ্গদের একাংশ আপত্তি ও সমালোচনা করলেও টুটু দাবি করতেন, তার এসব বক্তব্য রাজনৈতিক নয়, বরং ধর্মীয়ই। কারণ ধর্মই মানুষকে বৈষম্যের বিপক্ষে সাম্যের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার শিক্ষা দেয়।
আপার্থাইড সরকারের বিদায়ের পর ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে জিতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হন নেলসন ম্যান্ডেলা। নিজে বর্ণবিদ্বেষ ও নিপীড়নের শিকার এবং দীর্ঘ ৩০ বছর কারাভোগ করলেও প্রেসিডেন্টের পদে বসে ম্যান্ডেলা শ্বেতাঙ্গদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেন। তবে নিপীড়নের ঘটনাগুলো চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করার স্বার্থে তিনি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করেন। ম্যান্ডেলা এই কমিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন তার বন্ধু আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুকে।
ম্যান্ডেলার মত টুটুও আপার্থাইড পরবর্তী যুগে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ ভেদাভেদ ভুলে সকলে মিলে দক্ষিণ আফ্রিকার পুনর্গঠনের বার্তা দেন। ডেসমন্ড টুটু এই ধারণার নাম দিয়েছিলেন ‘রেইনবো নেশন’, অর্থাৎ এমন এক জাতিব্যবস্থা যেখানে সব সম্প্রদায়েরই প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তবে জীবনের শেষ বছরগুলোতে ডেসমন্ড টুটু আক্ষেপ করেছেন এমন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত পূরণ না হওয়ার।