উত্তর কোরিয়া একের পর এক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মিসাইল উৎক্ষেপণ করে গত কয়েক বছর ধরেই বিশ্বকে অবাক করে আসছে। এবার তারা সবাইকে চমকে দিল আরেকভাবে।
কিছুদিন আগে দেশটি পরীক্ষা চালায় দূরপাল্লার হোয়াসং-১২ ব্যালিস্টিক মিসাইলের। এই মিসাইলটি গত ৫ বছরে দেশটির উৎক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী।
এই ক্ষেপণাস্ত্রটিই যাত্রার সময় নিচে পৃথিবীর কিছু ছবি তোলে। আজ সেগুলোই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে উত্তর কোরিয়া। ছবিগুলোতে পুরো কোরিও উপদ্বীপ এবং আশেপাশের আরও কিছু এলাকা দেখা যাচ্ছে।
হোয়াসং-১২ শ্রেণীর মিসাইলগুলো কয়েক হাজার মাইল দূরের লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে সক্ষম। সেইমত এই ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের গুয়াম উপকূলেও পৌছে যেতে পারে। স্বভাবতই ক্ষেপণাস্ত্রটির পরীক্ষার পর এর কড়া নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত কয়েক বছর ধরেই উত্তর কোরিয়ার দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির এই কার্যক্রমের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। শুধু গত মাসেই সাতটি ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করেছে পিয়ংইয়ং।
দেশটির ঘন ঘন এভাবে আন্তমহাদেশীয় মিসাইল পরীক্ষা চালানোর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যা না মানায় অতীতে বহুবার অর্থনৈতিক অবরোধের মুখেও পড়েছে দেশটি। কিন্তু কোনভাবেই নিজের সামরিক উচ্চাকাঙখা থেকে নিবৃত করা যায়নি কিম জং উনকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, উত্তর কোরিয়ার গত কয়েক সপ্তাহের কর্মকান্ডের কারণে দেশটির সাথে তাদের আলোচনার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করবে।
হোয়াসং-১২ মিসাইল
উত্তর কোরিয়া গত সপ্তাহে দূরপাল্লার হোয়াসং-১২ ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার পর প্রথম তা শনাক্ত করে প্রতিবেশী জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থায় ধরা পড়ে হোয়াসং-১২ এর গতিবিধি।
দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান ধারণা দিয়েছে, উৎক্ষেপিত মিসাইলটি প্রায় ৮০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে করেছে। আর এটি ২,০০০ কিলোমিটার ওপর পর্যন্ত উঠেছিল। তবে নিজের সর্বোচ্চ সক্ষমতায় এবং আবহাওয়াসহ অন্যান্য পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে এই মিসাইল ৪,০০০ কিলোমিটার দূরত্বও অতিক্রম করতে পারে। উৎক্ষেপণের কয়েক ঘন্টা পর মিসাইলটি জাপানের সমুদ্রসীমায় এসে পড়ে।
রবিবার উৎক্ষেপণের পর সোমবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হোয়ানং-১২ মিসাইলের পরীক্ষার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে জানায় উত্তর কোরিয়া। দেশটি সচরাচর ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার পরের দিন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের মাধ্যমেই তা ঘোষণা করে থাকে।
উত্তর কোরিয়ার সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘কোরিয়ান সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সি’ (কেসিএনএ) তাদের আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় বলেছে, এই পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের দেশ নিজেদের সক্ষমতা আবারও জানিয়ে দিল। তারা বলেছে, উৎক্ষেপণের গতিপথ তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই এমনভাবে নির্ধারণ করেছে যাতে প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তা কোনভাবে বিঘ্নিত না হয়।
আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং তাক লাগানোর মত যা সংবাদ সংস্থাটি প্রকাশ করেছে তা হল চারটি ছবি। তাদের দাবিমত ছবিগুলো তোলা হয়েছে হোয়াসং-১২ ক্ষেপণাস্ত্র থেকে। যাত্রাপথের বিভিন্ন পর্যায়ে এই ছবিগুলো নেওয়া হয় বলে জানিয়েছে কেসিএনএ। ছবি তোলার জন্য ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেডে অর্থাৎ মিসাইলটির মাথায় যেখানে বিস্ফোরক রাখা হয় সেখানে ক্যামেরা সংযুক্ত রাখা হয়েছিল।
ছবিগুলোর একটিতে ক্ষেপণাস্ত্রটি উৎক্ষেপণের ঠিক পরমূহুর্তের দৃশ্য দেখা যায়। আরেকটি ছবি মিসাইলটি মহাকাশ থেকে নিচে নামার সময় তোলা হয়েছে যেখানে উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপানসহ আশেপাশের আরও কিছু দেশের ভূখন্ড দেখা যাচ্ছে।
রবিবারের মিসাইল উৎক্ষেপণের সময় উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন উপস্থিত ছিলেননা। সচরাচর ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার দিন সশরীরে উৎক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করে থাকেন কিম।
কেন এই মিসাইল পরীক্ষা করছে পিয়ংইয়ং?
উত্তর কোরিয়া গত কয়েক বছরে যতগুলো ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে তার সবগুলোই উচ্চপাল্লার। কোন কোনটি দেশটির প্রধান ‘শত্রু’ যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে আঘাত হানতে সক্ষম। প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র সচরাচর আগেরটির চেয়ে বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।
উত্তর কোরিয়া এই নিয়ে মোট ছয়বার হোয়াসং-১২ মিসাইলের পরীক্ষা চালিয়েছে। এরমধ্যে রবিবারেরটিই সবচেয়ে বড়।
ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চলমান আলোচনায় নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতেই শক্তিশালী এই ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালালো দেশটি।
২০১৮ সালে যখন কিম জং উন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন, তখন উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে পরমাণু গবেষণা এবং আন্তমহাদেশীয় মিসাইল পরীক্ষার ব্যাপারে সংযম দেখাবে তারা।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই দেশটি আবারও একদিকে পুরোমাত্রায় তাদের পরমাণু কর্মসূচি শুরু করে এবং একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাতে থাকে। পিয়ংইয়ং দাবি করে তাদের আগের দেওয়া ঘোষণা বহাল রাখতে তারা বাধ্য নন।