আজ থেকে চার বছরেরও কম সময় আগে ভোলোদিমির জেলেন্সকি ছিলেন ইউক্রেনের খ্যাতনামা কমেডিয়ানদের একজন। টেলিভিশনে দূর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিকদের ব্যঙ্গ করে বানানো এক শো’য়ের মাধ্যমে পুরো ইউক্রেনজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পান তিনি।
‘সারভেন্ট অব দ্য পিপল’ নামের ঐ কমেডি শো’তে মূল ভূমিকায় অভিনয় করতেন জেলেন্সকি। প্রকৃত অর্থেই জনগণের সেবক কিভাবে হতে হয়, গতানুগতিক রাজনীতিবিদদের কটাক্ষের মাধ্যমে তাই বোঝাতেন ভোলোদিমির জেলেন্সকি। আর তাতেই প্রচলিত রাজনীতির ওপর বীতশ্রদ্ধ ইউক্রেনবাসীর মন জয় করে নিয়েছিলেন যুবক জেলেন্সকি।
পরবর্তী সময়ে নিজেই রাজনীতিক ও আরও পরে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসা জেলেন্সকি চার বছর পর আজ গণ্য হচ্ছেন বর্তমান সময়ে গোটা বিশ্বের সবচেয়ে সাহসী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। প্রবল পরাক্রমী রাশিয়ার ভয়াবহ আক্রমণের সামনে দাড়িয়েও ময়দান না ছেড়ে পুরো দেশকে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে গড়েছেন বীরত্বের নতুন সংজ্ঞা।
কিন্তু কে এই ভোলোদিমির জেলেন্সকি?
ভোলোদিমির জেলেন্সকির জন্ম ১৯৭৮ সালের ২৫ জানুয়ারি ইউক্রেনে, যা তখন ছিল অবিভক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত। জেলেন্সকি যখন খুব ছোট তখন সপরিবারে তাদের চলে যেতে হয়েছিল মঙ্গোলিয়ায়। সেখান থেকে আবার ইউক্রেনে ফিরে স্কুলে ভর্তি হন তিনি। রুশ প্রভাবিত এলাকায় বড় হওয়ায় শৈশবে রুশ ভাষাতেই সাবলীলতা অর্জন করেন জেলেন্সকি। তবে পরবর্তীতে ইউক্রেনীয় ও ইংরেজী ভাষাতেও সমানভাবে পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। ২০০০ সালে আইন বিভাগে উচ্চশিক্ষা শেষ করেন জেলেন্সকি।
আইন বিষয়ে পড়াশোনা করলেও শিক্ষাজীবন থেকেই তার ক্যারিয়ার অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। ছাত্রাবস্থাতেই যোগ দেন থিয়েটারে। অভিনয়, বিশেষ করে কৌতুক অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ থেকেই তিনি মঞ্চ ও টেলিভিশনের বিভিন্ন কমেডি শো ও প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে থাকেন। পরিচিতি অর্জনের পর বেশ কয়েকটি সিনেমাতেও অভিনয়ের সুযোগ পান জেলেন্সকি। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘প্রজভস্কি ভার্সাস নেপোলিয়ান’ (২০১২), ‘এইট ফার্স্ট ডেটস’ (২০১২) ও ‘এইট নিউ ডেটস’ (২০১৫)।
২০১৫ সালে ভোলোদিমির জেলেন্সকি তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে আলোচিত কাজটি শুরু করেন। এটি ছিল টেলিভিশনের জন্য নির্মিত একটি কমেডি সিরিজ, নাম ‘সারভেন্ট অব দ্য পিপল’। এতে একজন সাধারণ ইউক্রেনীয় শিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেন জেলেন্সকি। সিরিজের কাহিনী অনুযায়ী, একবার দূর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া এক বক্তব্য রাখছিলেন ইতিহাসের সেই শিক্ষক। সেসময় তারই এক ছাত্র বক্তৃতাটি ভিডিও করে ছেড়ে দেয় ইন্টারনেটে। মূহুর্তেই সেটি ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর জনগণের চাপে সেই শিক্ষক সিদ্ধান্ত নেন নিজেই প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করার এবং শেষ পর্যন্ত জয়ীও হন।
সিরিজটি ইউক্রেনজুড়ে এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে ২০১৮ সালে জেলেন্সকিসহ এর কলাকুশলীরা একই ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’ নামে একটি রাজনৈতিক দলই খুলে ফেলেন।
পরের বছর ২০১৯ সালে ইউক্রেনে অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ‘সার্ভেন্ট অব দ্য পিপল’ দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হন ভোলোদিমির জেলেন্সকি। টেলিভিশন শোয়ের বদৌলতে পুরো দেশেই তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ। তার ওপর দূর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে জেলেন্সকির স্পষ্ট অবস্থান নির্বাচনের মাঠে তাকে আরও এগিয়ে দেয়। ফলস্বরূপ প্রথম দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অন্য প্রার্থীদের পেছনে ফেলে ভোলোদিমির জেলেন্সকি একাই পান ৩০ শতাংশের বেশি ভোট। ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কো পান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৬ শতাংশ ভোট। বাকিরা আরও পেছনে।
কোন প্রার্থীই অর্ধেকের বেশি ভোট না পাওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীকে নিয়ে দ্বিতীয় দফার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর তাতে ৭৩ শতাংশ ভোট পেয়ে দেশে-বিদেশে তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন কমেডিয়ান থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ভোলোদিমির জেলেন্সকি।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এক ধনকুবের ব্যবসায়ী সাথে তার আর্থিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে করোনার প্রকোপের দিনগুলোতে জারি করা বিধিনিষেধ নিয়ে অসন্তোষসহ নানা কারণে ওঠানামা করে জেলেন্সকির জনপ্রিয়তা। তবে রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি জেলেন্সকি হন ২০২১ সালের শেষে এসে।
সেসময় খবর আসতে থাকে প্রতিবেশী রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তের তিন দিকে লক্ষাধিক সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে। ভারী সমরাস্ত্রে সজ্জিত এসব সেনা পূর্ব ও দক্ষিণে রাশিয়ার ভূখন্ড ও জলসীমা ছাড়াও উত্তরে আরেক প্রতিবেশী বেলারুশেও অবস্থান নিয়ে আছে। মস্কো অস্বীকার করলেও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার সম্ভাব্য আগ্রাসন নিয়ে সরব হয়। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানূয়েল ম্যাক্রোসহ পশ্চিমা নেতারা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যেকোনো সামরিক অভিযান চালানো থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট হন।
কিন্তু রাশিয়া তাদের সামরিক প্রস্তুতি অব্যাহত রাখে। ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুই প্রদেশকে ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা করেন পুতিন। এর তিন দিনের মাথায় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরুর ঘোষণা দেন ভ্লাদিমির পুতিন। এর পরপরই ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে আছড়ে পড়তে শুরু করে রুশ মিসাইল। শুরু হয়ে যায় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ।
যুদ্ধ শুরুর পরপরই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেন্সকি নিজ দেশের সেনা ও নাগরিকদের অস্ত্র হাতে নিয়ে রাশিয়ার হামলার মোকাবেলার আহবান জানান। একের পর এক ভিডিও বার্তায় হাল না ছাড়ার ডাক দেন তিনি। শুভাকাঙখীদের অনুরোধ সত্ত্বেও রাজধানী কিয়েভ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে অস্বীকৃতি জানান জেলেন্সকি। আর এসবই রাতারাতি তাকে পরিণত করে ইউক্রেনের নতুন নায়কে। পরাক্রমী রাশিয়ার ক্রমাগত হামলার মুখে সাহসের সাথে সীমিত শক্তি দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অদ্যম মানসিকতা তাকে ইউক্রেনের গন্ডি ছাড়িয়ে পুরো বিশ্বেই বীরের মর্যাদা এনে দেয়।
জেলেন্সকির দৃঢ় অবস্থানের কারণেই ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ও সাধারণ মানুষ রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে কঠোর ও কার্যকর এক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। যুদ্ধ শুরুর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই রাজধানী কিয়েভের পতন ঘটবে বলে ধারণা করা হলেও ইউক্রেনীয়দের দূর্ভেদ্য প্রতিরোধের কারণে দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনও তা করে উঠতে পারেনি রাশিয়া। উপরন্তু উৎসাহিত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এখন অত্যাধুনিক অস্ত্র পাঠিয়ে ইউক্রেনের যোদ্ধাদের শক্তি আরও বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে। সীমান্তবর্তী কিছু অঞ্চল রাশিয়ার দখলে এলেও ইউক্রেনের সিংহভাগ এলাকা এখনও জেলেনস্কির সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আর অন্তত এখন পর্যন্ত ইউক্রেনের এই সাফল্যের কৃতিত্ব সকলেই দিচ্ছেন কেবল একজনকে, তিনি ভোলোদিমির জেলেন্সকি। যিনি সাহসের সাথে মাটি কামড়ে পড়ে না থাকলে তার দেশবাসী হয়ত অকল্পনীয় এই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারতনা, আর পশ্চিমা দেশগুলোও আরও সরঞ্জাম পাঠিয়ে ইউক্রেনের অবস্থানকে দৃঢ়তর করার উৎসাহ পেতনা। তাই যুদ্ধের ফলাফল শেষ পর্যন্ত যাই হোকনা কেন, ইতিহাসের পাতায় এরই মধ্যে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন ভোলোদিমির আলেক্সান্দ্রোভিচ জেলেন্সকি।