রাশিয়ার গর্বের এক যুদ্ধজাহাজ, যা ইউক্রেনের কথিত মিসাইল হামলায় গতকাল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল, আজ ডুবে গেছে কৃষ্ণসাগরে।
কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন থাকা রুশ নৌবহরের প্রধান ও নেতৃত্বদানকারী যুদ্ধজাহাজটির নাম ‘মস্কোভা’। রাশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং গৌরবের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় সামরিক এই নৌযানটিকে।
ইউক্রেন গতকাল দাবি করেছিল, তাদের ছোড়া মিসাইল আঘাত হেনেছে যুদ্ধজাহাজ মস্কোভার গায়ে। এতে বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছে যুদ্ধজাহাজটি।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তর এক বিবৃতিতে বিস্ফোরণের জেরে মস্কোভার ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কথা স্বীকার করলেও হামলার কারণে এমনটা ঘটার কথা অস্বীকার করেছে। দেশটির বক্তব্য, যুদ্ধজাহাজটিতে গোলাবারুদের গুদামে বিস্ফোরণ ঘটলে এটি বিধ্বস্ত হয় এবং এতে আগুন ধরে যায়।
ইউক্রেন আজ জানিয়েছে, কয়েক ঘন্টা ভেসে থাকার পর ক্ষতিগ্রস্থ যুদ্ধজাহাজ মস্কোভা কৃষ্ণসাগরে নিমজ্জিত হয়েছে। রাশিয়ার তরফে এই তথ্য স্বীকার করে নেওয়া হলেও তাদের দাবি, সমুদ্রের ঝোড়ো বাতাস ও ঢেউয়ের তোড়ে ডুবে গেছে দুর্ঘটনাগ্রস্থ মস্কোভা। দেশটি বলেছে, যুদ্ধজাহাজটিতে থাকা সকল নাবিক ও ক্রুদের উদ্ধার করে কৃষ্ণসাগরে মোতায়েন অন্য রুশ জলযানে স্থানান্তরিত করা হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের বক্তব্য সমর্থন করে জানিয়েছে, তাদেরও ধারণা, দূর্ঘটনা নয় বরং ইউক্রেনীয় মিসাইলের আঘাতেই ধ্বংস হয়েছে রুশ জাহাজ মস্কোভা।
কয়েক ঘন্টা আগে ইউক্রেন বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, ধ্বংসপ্রাপ্ত যুদ্ধজাহাজ মস্কোভা ডুবে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু রাশিয়া তা নাকচ করে পাল্টা বিবৃতি দিয়ে দাবি করে, মস্কোভা এখনও ভেসে আছে। তবে বৃহস্পতিবার বেলা গড়াতেই রুশ প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকেও জাহাজটি ডুবে যাওয়ার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়।
৫১০ জন ক্রু বহনে সক্ষম যুদ্ধজাহাজ মস্কোভার ওজন ১২,৪৯০ টন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মস্কোভাই যুদ্ধ চলাকালীন সময় ধ্বংস হওয়া রাশিয়ার সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ।
মস্কোভার ডুবে যাওয়া প্রসঙ্গে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তর প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, “ক্ষতিগ্রস্থ জাহাজটি নিকটস্থ বন্দরে নোঙর করা ছিল। গোলাবারুদের গুদামে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকান্ডের কারণে জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় একসময় এটি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এর সাথে সমুদ্রের তীব্র স্রোত যুক্ত হওয়ায় মস্কোভার পক্ষে আর ভেসে থাকা আর সম্ভব হয়নি এবং একসময় জাহাজটি ডুবে যায়।
এদিকে রাশিয়া জাহাজের ক্রুদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার দাবি করলেও ইউক্রেন বলেছে, মিসাইল হামলা এবং এর জেরে হওয়া অগ্নিকান্ডের সময় মস্কোভার ক্যাপ্টেন আন্টন কুপ্রিন মারা গেছেন।
ইউক্রেনের সামরিক কর্তারা জানিয়েছেন, রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজটি ইউক্রেন ধ্বংস করেছে নিজেদের তৈরি ‘নেপচুন’ মিসাইল দিয়ে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেওয়া এবং কৃষ্ণসাগরে ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধির সময় থেকেই নিজস্ব এবং যথেষ্ঠ শক্তিশালী এই মিসাইল ‘নেপচুন’ তৈরির উদ্যোগ নেয় ইউক্রেন।
সিনিয়র এক মার্কিন সেনা অফিসার আজ জানিয়েছেন, দু’টো নেপচুন মিসাইল আঘাত হেনেছে মস্কোভা যুদ্ধজাহাজটিতে। ঐ অফিসার আরও বলেছেন, তাদের ধারণা, মিসাইল হামলায় জাহাজটিতে প্রাণহানিও ঘটেছে, তবে নিহত বা আহতের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে তারা নিশ্চিত নন।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান শুরুর দিনই আলোচিত এক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল মস্কোভা, যেটি প্রকাশ পায় কয়েকদিন পর। কৃষ্ণসাগরে অবস্থিত ‘স্নেক আইল্যান্ড’ দ্বীপে ইউক্রেনীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ছোট একটি দলকে এই মস্কোভা থেকে সেদিন আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে বেতারবার্তা পাঠিয়েছিল রুশ সেনারা। জবাবে খুব কড়া ভাষায় সে আহবান প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা বার্তা পাঠায় ইউক্রেনের ঐ দলটি। তাদের সেই সাহসী বেতার বার্তা কয়েকদিন পর গণমাধ্যমে প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন ফেলে দেয়।
মস্কোভা যুদ্ধজাহাজটি নির্মিত হয়েছিল সোভিয়েত আমলে। ৮০’র দশকের শুরুতে এটি সোভিয়েত নৌবাহিনীতে সংযুক্ত হয়। এটি সিরিয়ার সাম্প্রতিক গৃহযুদ্ধের সময়ও মধ্যপ্রাচ্যে দায়িত্ব পালন করেছে।
ধ্বংস হওয়ার সময় জাহাজটি ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চনের মিকোলাইভ শহরের উপকূলে নোঙর করা ছিল।
জানা গেছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর মস্কোভা থেকে সরাসরি দেশটিতে কোন ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়নি। এটি শুধুমাত্র কৃষ্ণসাগরের রুশ নৌবহরের অন্যান্য ছোট যুদ্ধজাহাজগুলোকে নিরাপত্তা দিত, মূলত যেগুলো থেকে মিসাইল নিক্ষেপ করা হত ইউক্রেনের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে।
মস্কোভার ধ্বংস হওয়া স্বভাবতই মনোস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করবে রুশ বাহিনীর ওপর। এটিই কৃষ্ণসাগরের বহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধজাহাজ ছিল। এটিতে সফলভাবে হামলা হওয়ায় বহরের অন্য জাহাজগুলোও এখন থেকে হামলার ঝুকিতে থাকবে। ধারণা করা হচ্ছে একারণেই ইউক্রেনের জলসীমার আরও ভেতরে প্রবেশ করার পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রাখবে রাশিয়ার নৌবাহিনী।