ব্রিটিশ সিংহাসনে ৭০ বছর পূর্ণ করলেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। দেশটির সুদীর্ঘ ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসনে থাকা রাজশাসক এখন তিনিই।
ব্রিটিশ রাজপরিবারের হাজার বছরের ইতিহাসে আর কোনো রাজা কিংবা রাণীই এত দীর্ঘকাল ব্রিটেন শাসন করতে পারেননি। দায়িত্ব গ্রহণের ৭০ বছর পূর্তির এই উপলক্ষটিকে প্লাটিনাম জুবিলি হিসেবে পালন করা হচ্ছে ব্রিটেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
ঐতিহাসিক এই দিনটির প্রাক্কালে একনজরে দেখে নেওয়া যাক রাণী হিসেবে এলিজাবেথের সাত দশকের যাত্রার বিশেষ কিছু দিক।
কিভাবে রাণী হলেন এলিজাবেথ
১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনে জন্ম নেন এলিজাবেথ। ভবিষ্যৎে রাণী হওয়ার স্বাভাবিক কোনো সম্ভাবনাই ছিলনা এলিজাবেথের। কারণ সেসময় রাজা ছিলেন তার পিতা জর্জের বড় ভাই এডওয়ার্ড। তার সন্তান থাকলে তাদেরই কারও ভবিষ্যৎে সিংহাসনে বসার কথা ছিল।
কিন্তু ১৯৩৬ সালে সিংহাসনে বসার মাত্র এক বছরের মাথায়ই ব্যক্তিগত কারণে ক্ষমতা ছেড়ে দেন এডওয়ার্ড। প্রথা অনুযায়ী নতুন রাজা হন তার ছোট ভাই জর্জ। ছোট্ট এলিজাবেথের বয়স তখন মাত্র ১০।
১৯৫২ সালে হঠাৎই মৃত্যুবরণ করেন রাজা জর্জ। এলিজাবেথ তথন বিদেশে রাষ্ট্রীয় সফরে। দ্রুত দেশে ফেরেন ২৫ বছরের তরুণী এলিজাবেথ। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ষোল মাস পর ১৯৫৩ সালের ২ জুন ব্রিটিশ সিংহাসনে অভিষিক্ত হন তিনি। অতীতে আরও এক ব্রিটিশ রাণীর একই নাম থাকায় তিনি অনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ হিসেবে।
কমনওয়েলথেরও প্রধান
সিংহাসনে বসার মধ্য দিয়ে এলিজাবেথ শুধু ব্রিটেনের রাণীই হননি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশেরও রাষ্ট্রপ্রধানে পরিণত হন। কারণ স্বার্বভৌম রাষ্ট্র হলেও এই দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটেনের রাজশাসকদেরই তাদের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে।
এছাড়াও কমনওয়েলথ জোটেরও প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান এলিজাবেথ। অতীতে কোনো সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল, এমন দেশগুলোকে নিয়ে গঠিত জোট এই কমনওয়েলথ।
এলিজাবেথের অভিষেকের সময় কমনওয়েলথের সদস্য ছিল মাত্র ৮টি রাষ্ট্র। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৪। আয়তন, ব্যাপ্তি ও সদস্য সংখ্যায় জাতিসংঘের পরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জোট এই কমনওয়েলথই। আড়াইশো কোটিরও বেশি লোক বাস করে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে। সেই হিসেবে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর জোট এটি।
রুয়ান্ডা ও ক্যামেরন ছাড়া এই দেশগুলোর প্রত্যেকটিতেই সফর করেছেন রাণী এলিজাবেথ। অনেকগুলোতে গিয়েছেন একাধিকবার।
বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশের মুদ্রায় রাণী এলিজাবেথের ছবি রয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর আর কোনো শাসকের ছবি এতগুলো দেশের নোট বা কয়েনে মুদ্রিত নেই। ব্রিটিশ রাষ্ট্র ও সরকারের সাথে সাথে দেশটির সামরিক বাহিনী ও দেশটির সর্বোচ্চ চার্চেরও আনুষ্ঠানিক প্রধান এলিজাবেথ।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীদের সাথে রাণী
রাণী এলিজাবেথ ব্রিটেনের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রপ্রধান। দেশটির নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকারের হাতে। রাণীর সাংবিধানিক দায়িত্ব হল, সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া। প্রতি সপ্তাহে বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে রাণীর কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়া ছাড়াও তাকে সরকারের নিয়মিত কার্যক্রম অবহিত করে আসেন প্রধানমন্ত্রীরা।
এলিজাবেথের ৭০ বছরের শাসনামলে মোট ১৪ জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন ব্রিটেনে। উইনস্টন চার্চিল থেকে শুরু করে সর্বশেষ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, রাণীর সাথে প্রত্যেকেই নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। রাণীও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপলক্ষে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীদের আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন।
রাণী এলিজাবেথের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব হল ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রতি বছরের কার্যক্রম উদ্বোধন করা। তার ৭০ বছরের শাসনকালে কেবল ১৯৫৯ ও ১৯৬৩ সালে গর্ভবতী থাকার কারণে এবং এবছর ২০২২ সালে শারীরিক অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিত থাকা ছাড়া প্রত্যেক বছরেরই শুরুতে সংসদের কার্যক্রম সশরীরে উদ্বোধন করে এসেছেন রাণী এলিজাবেথ।
সংকটের মূহুর্তগুলো
দীর্ঘ সাত দশকের শাসনামলে বেশ কিছু সংকটময় সময়ও পার করেছেন রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। এরকম একটি বছর ছিল ১৯৯২ সাল। স্বয়ং রাণী বছরটিকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে অভীহিত করেছিলেন। রাণীর চার সন্তানের মধ্যে দুই পুত্র প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্স আন্ড্রু এবং কন্যা প্রিন্সেস আন, কাকতালীয়ভাবে তিনজনেরই বিবাহবিচ্ছেদ হয় ১৯৯২ সালে। এছাড়া বছরটির শেষভাগে আগুনে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় রাজপরিবারের দ্বিতীয় প্রধান আবাস উইন্ডসর প্রাসাদ। এলিজাবেথের শৈশবের বড় একটা অংশ কেটেছে এই প্রাসাদে।
এরপর রাণীর জীবনে আরেক সংকটময় সন হিসেবে আবির্ভূত হয় ১৯৯৭ সাল। প্যারিসে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারান প্রিন্স চার্লসের প্রাক্তন স্ত্রী প্রিন্সেস ডায়ানা। মৃত্যুর পর রাজপরিবারের পক্ষ থেকে ডায়ানার প্রতি যথাযথ সম্মান না দেখানোর অভিযোগে ব্রিটিশ সমাজে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন রাণী এলিজাবেথ। অবশ্য দ্রুতই সময়োচিত কিছু পদক্ষেপ নিয়ে সেসব সামলোচনা সামলেও উঠেছিলেন রাণী।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও দু’টো বিয়োগান্তক ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়েছে রাণী এলিজাবেথকে। ২০২১ সালে তার পৌত্র প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগান মারকেল রাজপরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এর ধারাবাহিকতায় প্রিন্স হ্যারি স্বেচ্ছায় রাজকীয় সকল পদবী ও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে স্ত্রী মেগানের সাথে স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান।
একই বছর প্রয়াত হন রাণী এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ। ছয় দশকেরও বেশি সময়ের দাম্পত্য জীবনে সকল পরিস্থিতিতে রাণীর পাশে থেকেছেন ৯৯ বছর বয়সে প্রয়াত প্রিন্স ফিলিপ।
এলিজাবেথের দু’টো রেকর্ড
ব্রিটিশ সিংহাসনে সবচেয়ে বেশি সময় আসীন থাকার রেকর্ডটি দীর্ঘদিন ধরে ছিল রাণী ভিক্টোরিয়ার দখলে। ২০১৫ সেই রেকর্ড ভাঙেন রাণী এলিজাবেথ। এই মূহুর্তে তিনিই দেশটির দীর্ঘ ইতিহাসের সর্বোচ্চ সময়ের শাসক।
এমনকি শুধু ব্রিটেনই হয়, সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় সিংহাসনে থাকা নারী রাজশাসকও এখন রাণী এলিজাবেথ।
এছাড়া রাণী ভিক্টোরিয়ার আরেকটি রেকর্ডও ভেঙে দিয়েছেন রাণী এলিজাবেথ। তা হল, সবচেয়ে বেশি বয়স পর্যন্ত সিংহাসনে থাকা। ভিক্টোরিয়া যখন প্রয়াত হন তখন তার বয়স ছিল ৮১। আর রাণী এলিজাবেথ এখন রয়েছেন ৯৬ বছর বয়সে।
সুস্থ এবং দৃঢ়চেতা এলিজাবেথ নির্বিঘ্নেই শত বছরও পার করবেন, এমনই প্রত্যাশা সবার।