চার দেশের অনানুষ্ঠানিক ‘চীনবিরোধী’ জোট কোয়াডের এবছরের শীর্ষ বৈঠক আজ বসতে চলেছে জাপানের রাজধানী টোকিওতে। দেশগুলোর শীর্ষনেতারা এরই মধ্যে এসে পৌছেছেন শহরটিতে। এবারের বৈঠকটিকে বর্ণনা করা হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আয়োজিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন হিসেবে।
একদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, অন্যদিকে একই কায়দায় তাইওয়ানে চীনা হামলার ঝুকি, সব মিলিয়ে অস্থির এক বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যে আজ মুখোমুখি হতে চলেছেন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের রাষ্ট্রনেতারা।
বিশ্বের তিন মহাদেশে এবং ভৌগোলিকভাবে একে অন্যের থেকে অনেকটা দূরত্বে অবস্থিত এই চারটি দেশের মধ্যে প্রধানতম মিল হল, পরাশক্তি চীনের সাথে প্রত্যেকেরই রয়েছে গভীর অবিশ্বাসের সম্পর্ক। বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠায় চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহুদিন ধরেই তিক্ত, জাপান ও ভারত উদ্বিগ্ন দেশটির সাথে চলা সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে আর অস্ট্রেলিয়ার মাথাব্যাথা দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের ক্রমাগত সামরিক শক্তিবৃদ্ধি নিয়ে, যে অঞ্চলটি তাদের জলসীমার খুব কাছে।
এই প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎে চীনের যেকোনো ‘বিপদজনক’ পদক্ষেপ মোকাবেলায় নিজেদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ বহুদিন ধরেই অনুভব করে এসেছে এই দেশগুলো। সেই ভাবনা থেকেই ২০০৭ সালে যাত্রা শুরু করে চার দেশের একটি জোট। তবে নানা কারণে পরের বছরই থমকে যায় সেটির কার্যক্রম। এর এক দশক পর ২০১৭ সালে আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয় জোটটিকে, নাম ‘কোয়াড’। তখন থেকে বিরতিহীনভাবেই কাজ করে যাচ্ছে জোটটি। নিজেদের সম্পর্ক এবং কর্মকান্ডকে গতিশীল রাখতে নিয়মিতভাবে শীর্ষ বৈঠকের আয়োজন করে আসছে এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো।
টোকিওর এবারের সম্মেলনটি নিয়ে চতুর্থবারের মত একত্রে মিলিত হতে যাচ্ছেন কোয়াডভুক্ত চার দেশের শীর্ষনেতারা। এর আগে ওয়াশিংটনে সশরীরে একবার এবং করোনা মহামারির সময় ভার্চুয়ালি দু’বার শীর্ষ বৈঠক হয়েছে কোয়াডের।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেদের সীমান্ত এলাকায় প্রাণঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়েছে চীন ও ভারত। উভয় পক্ষেরই অভিযোগ, এক দেশ আরেক দেশের ভূখন্ড অবৈধভাবে দখল করে রেখেছে। বিভিন্ন স্তরে বৈঠকের পর পরিস্থিতি আপাত শান্ত হলেও উত্তেজনা এখনও রয়েছে সীমান্তে।
এবছরে শুরু হওয়া ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন আহবান স্বত্তেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে ভারত। নিজেদের অর্থনীতির নিরাপত্তার স্বার্থেই জাতিসংঘসহ বিভিন্ন প্লাটফর্মে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবে নীরব থেকেছে দেশটি। এ ইস্যুতে শুরুতে ক্ষুব্ধ হলেও ভারতের বাধ্যবাধকতার কথা মেনে বিষয়টিতে নমনীয় হয় যুক্তরাষ্ট্র।
জাপানের সমুদ্রসীমার একটি অংশ চীনের সমুদ্রসীমার সাথে অভিন্ন। চীনা নৌবাহিনী প্রায়ই সেখানে ‘অস্বাভাবিক তৎপরতা’ চালায় বলে অভিযোগ টোকিওর। আলোচিত ‘সেনকাকু’ দ্বীপের মালিকানা নিয়েও বহুদিন ধরে বিবাদ চলে আসছে জাপান ও চীনের মধ্যে। এছাড়া পুরো দক্ষিণ চীন সাগরে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লক্ষ্যে চীনের চলমান বিতর্কিত সামরিক কর্মকান্ডে প্রতিবেশী অন্যান্য দেশের মত উদ্বিগ্ন জাপানও।
অতি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র সলোমন আইল্যান্ডের সাথে একটি নিরাপত্তা চুক্তি করেছে চীন। ঐ চুক্তির ফাস হওয়া খসড়া থেকে জানা গেছে, এর আওতায় ভবিষ্যৎে চীনের যুদ্ধজাহাজ সলোমন আইল্যান্ডে অবস্থান নিতে পারবে। এছাড়া দ্বীপরাষ্ট্রটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় ‘সহায়তা করতে’ সেখানে নিজেদের সেনা পাঠানোরও অধিকার পাবে বেইজিং। পুরো বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে অস্ট্রেলিয়া।
মাত্র একদিন আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় দাঁড়িয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, তাইওয়ান আক্রান্ত হলে সামরিকভাবে তার মোকাবেলা করবে যুক্তরাষ্ট্র। স্বভাবতই বাইডেনের এ বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বেইজিং। ফ্রেব্রুয়ারির শেষে ইউক্রেনে রাশিয়ার ঝাপিয়ে পড়া থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চীনও যেকোনো সময় তাইওয়ানে হামলা চালিয়ে বসতে পারে বলে আশঙ্কা মার্কিন প্রশাসনের।
অর্থাৎ চীনবিরোধী অবস্থান থেকে গড়ে ওঠা জোট কোয়াডের এবারের শীর্ষ বৈঠকেও আলোচনার কেন্দ্রে থাকতে চলেছে সেই চীনই। তবে এই ইস্যুর বাইরেও ইউক্রেন যুদ্ধ, উত্তর কোরিয়ার একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা, আফগানিস্তান পরিস্থিতির মত বিষয়গুলোও শীর্ষনেতাদের আলোচ্যসূচিতে স্থান পাবে বলে জানা গেছে।