তিয়েনানমান স্কোয়ারের গণহত্যার পর চীনের প্রেসিডেন্ট হওয়া জিয়াং জেমিন মারা গেছেন। কমিউনিস্ট এই নেতার বয়স হয়েছিল ৯৬।
চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, বুধবার স্থানীয় সময় রাত ১২টার কিছু পরে সাংহাইয়ে প্রয়াত হন জিয়াং জেমিন।
প্রেসিডেন্ট জিয়াং তার শাসনামলে চীনকে বহির্বিশ্বে আরও বেশি করে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তার নেওয়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উদারীকরণের সুযোগে চীনের অর্থনীতি ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাওয়া শুরু হয় তখন। আজকের চীনের দানবীয় অর্থনৈতিক প্রভাবের কারিগর হিসেবে তাই জিয়াং জেমিনকেই স্মরণ করা হয়।
সাবেক এই প্রেসিডেন্টের মৃত্যু এমন এক সময়ে ঘটল যখন কোভিড বিধিনিষেধের প্রতিবাদে দেশটির শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করছে চীন। দেশটির বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়া এই ক্ষোভপ্রকাশকে বিশ্লেষকরা দেখছেন ১৯৮৯ সালে তিয়েনানমান স্কোয়ারের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর দেশটিতে সবচেয়ে বড় সরকারবিরোধী প্রতিবাদ হিসেবে।
জিয়াং জেমিনের মৃত্যুর বিস্তারিত উল্লেখ করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি জানিয়েছে, লিউকিমিয়া এবং একই সাথে বিভিন্ন অঙ্গ অকার্যকর হয়ে পড়ায় তিনি মারা গেছেন।
বিবৃতিতে কমিউনিস্ট পার্টি জিয়াংকে উচ্চ মর্যাদার অসাধারণ নেতা এবং একজন পরীক্ষিত কমিউনিস্ট সৈনিক হিসেবে বর্ণনা করেছে।
শিনহুয়া, দ্য গ্লোবাল টাইমসসহ চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থাগুলো জিয়াং জেমিনের সম্মানে তাদের ওয়েবসাইটগুলো সাদা-কালোয় রূপান্তরিত করে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিসিটিভি ১৯৮৯ সালে তিয়েনানমান স্কোয়ারের আলোচিত ঘটনাপ্রবাহের পর তার নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রশংসা করে।
১৯৮৯ সালে তিয়েনানমান স্কোয়ারে গণতন্ত্রপন্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তীতে তাদের কঠোরভাবে দমনের দিনগুলোতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরেও বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছিল। কট্টরপন্থী ও উদারপন্থীদের সেই দ্বন্দের মধ্যেই পার্টির শীর্ষনেতা তথা দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় জিয়াং জেমিনকে। সরকারি কর্মকর্তা থেকে রাজনীতিতে আসা মধ্যপন্থী জিয়াং উভয়পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পারবেন, এই প্রত্যাশাতেই তাকে প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়েছিল পার্টির নেতৃত্ব।
প্রেসিডেন্ট জিয়াংও শেষ পর্যন্ত পার্টির অভ্যন্তরে চলা মতভেদের রাশ টানতে পেরেছিলেন। তবে তার এক দশকের শাসনামলে তিনিও কমিউনিস্ট পার্টির ওপর আসা সকল রাজনৈতিক হুমকি কড়া হাতে দমন করেছিলেন। রাজনৈতিক সংস্কার থেকে সরকারের সমালোচনা, সবকিছুতেই তার অবস্থান ছিল কঠোর।
জিয়াং জেমিনের আমলে ১৯৯৭ সালে হংকংকে চীনের কাছে ফিরিয়ে দেয় ব্রিটেন। ২০০১ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অন্তর্ভূক্তি ঘটে চীনের। মূলত এই পদক্ষেপের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে প্রবেশ করে দেশটি, যার ধারাবাহিকতায় আজ বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন।
চীনের আজকের প্রতিদ্বন্দী যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন জিয়াং জেমিন। নিজ শাসনামলে বেশ কয়েকবার ওয়াশিংটন সফর করেন জিয়াং। পূর্বতন চীনা প্রেসিডেন্টদের তুলনায় অনেকটাই প্রাণবন্ত ও আন্তরিক ছিল সেসব সফর। কখনো কোনো সম্মেলনে এলভিস প্রিসলির গান গেয়েছেন, আবার কখনো সাঁতার কেটেছেন হাওয়াইয়ের উপকূলে।
২০০১ সালে নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধেও’ সমর্থন জানান প্রেসিডেন্ট জিয়াং।
২০০২ সালে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে অবসরের পর অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান জিয়াং জেমিন। বার্ষিক সামরিক কুচকাওয়াজ কিংবা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনের মত কিছু আয়োজন ছাড়া খুব একটা প্রকাশ্যে দেখা যেতনা তাকে।
প্রয়াত জিয়াং জেমিনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৬ ডিসেম্বর। এতে জিয়াংয়ের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং অংশ নেবেন। তবে প্রথামাফিক বিদেশি কোন রাষ্ট্রপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানানো হবেনা জিয়াং জেমিনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে।